দিল্লির চিঠি-দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকতার কঠিন সময় by কুলদীপ নায়ার

স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটলে ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে—এই চিন্তা যেকোনো সাংবাদিকের জন্য আতঙ্কজনক। অথচ, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে এই আতঙ্কে থেকেই কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের। কেননা, এখানকার শাসকেরা সন্ত্রাসীদের মতোই স্পর্শকাতর। তবু সাংবাদিকেরা তাঁদের পেশাগত দাবি থেকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন।

আরও এক সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে নিহত হলেন ভারতের মুম্বাইয়ে। তাঁর ‘অপরাধ’ মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের কীর্তিকলাপ তিনি উন্মোচন করেছিলেন। এ ঘটনায় পুলিশ ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন নাক গলাচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে দাউদ ভাইদের হাত থাকার কথা বলা হচ্ছে। এদের হাত আদতেই খুব লম্বা ও শক্তিশালী। পুলিশের কোনো কোনো সদস্য এদের কাছ থেকে মাসোহারা পান নিশ্চয়ই। কী আশ্চর্যের বিষয়, পুলিশ ও সন্ত্রাসী একই পাত্রের!
এ ঘটনার কয়েক দিন আগে পাকিস্তানে নিহত হলেন সাংবাদিক সৈয়দ সেলিম শাহজাদ। ইলিয়াস কাশ্মীরি মার্কিন পাইলটবিহীন বিমান হামলায় নিহত হওয়ার এক মাস আগে সেলিম তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। কাশ্মীরির আমন্ত্রণে তিনি সেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
শাহজাদ তাঁর ইনসাইড আল-কায়েদা অ্যান্ড দ্য তালেবান: বিয়ন্ড বিন লাদেন অ্যান্ড ৯/১১ বইয়ে দাবি করেছেন, মুম্বাই হামলাকে কাশ্মীরি গণ্য করেছেন ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধে জড়ানোর উদ্দেশ্যে ‘বিরাট অভিযান’ হিসেবে। আফগানিস্তান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের ওপর শাহজাদ বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তানি দৈনিকে তাঁর বইটির অংশবিশেষ ছাপা হয়েছিল। এর পরই তাঁকে মেরে ফেলা হয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এই আক্রমণের নিন্দা জানাননি সরকারের কেউ। তদন্তের মতো কোনো তদন্তও হয়নি। সাধারণের ধারণা, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এটা সত্যি নয় ধরে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য তদন্ত পরিচালনা করে খুঁজে বের করতে হবে, কাশ্মীরির সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর শাহজাদকে কেন খুন হতে হলো। কাশ্মীরি সেই সাক্ষাৎকারে আইএসআই বা অন্য কোনো নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন।
উদারনৈতিকেরা পাকিস্তানে দ্রুত পিছু হটছেন। দেশটিতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ইসলামি মতাদর্শের ভিত্তিতে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চান। ইসলামি শাসনের মানে কী, তা আফগানিস্তানে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকাকালে দেখিয়েছে তালেবান। তারা হয়তো উপলব্ধি করছে না, লাহোর, করাচি, পেশোয়ার কিংবা ওয়াজিরিস্তানে তারা মুসলমানদেরই মারছে। এই পরিবেশে স্বাধীন গণমাধ্যম কাজ করতে পারবে কীভাবে?
পাঁচ বছর আগে শ্রীলঙ্কায় সাংবাদিক সম্পথ লাকমাল ডি সিলভাকে খুন করা হয়েছিল; কারণ ‘তাঁর কাছে প্রতিরক্ষা বিষয়ে অনেক তথ্য ছিল’। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার জনগণ একের পর এক কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক দেখেছে। পূর্ববর্তীদের মতো রাজাপক্ষেও কোনো সমালোচক পছন্দ করেন না।
লেকহাউস কোম্পানির অধীনে একগুচ্ছ সংবাদপত্র এখন সরকারের সম্পত্তি। তার পরও শ্রীলঙ্কার সরকার এখনো দাবি করে, সংবাদপত্র স্বাধীন।
বাংলাদেশের সরকার মৌলবাদের প্রতি কোনো দরদ দেখায় না—এ দিক থেকে অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। কিন্তু গণমাধ্যম স্বাধীন শুধু কাগজেই। মৃদু সমালোচনাও পছন্দ হয় না ক্ষমতাবানদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও উদারপন্থী, তবে এত স্পর্শকাতর যে গুটিকয়েক পত্রিকা কখনো সখনো সমালোচনা করেই হয়তো স্থায়ীভাবে তাঁর কোপানলে পড়ে গেছে। গণমাধ্যমকে উদ্দেশ করে বলার সময় ‘আমরা’ ও ‘তারা’—এভাবে তাঁকে কথা বলতে দেখা যায়। বিষয়টি তিনি এভাবে দেখেন—‘আমরা’ সরকার চালাই আর ‘তারা’ সব সময় সরকারকে উত্ত্যক্ত করে। তাঁর গণতান্ত্রিক সহজাত গুণ প্রশংসনীয় হওয়া সত্ত্বেও সমালোচকেরা যখন সবার জন্য সমান ক্ষেত্র দাবি করেন, তখন সেই গুণ ভোঁতা হয়ে পড়ে।
আমার দেশ ভারতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে প্রাণ হারাতে হয়েছে হুইসেল ব্লোয়ার হওয়া অথবা পুলিশের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে। সাংবাদিকতা পেশার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। হুকুম তামিল না করায় সাংবাদিকের চাকরি হারানোর ঘটনা অনেক বেড়েছে। ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে না হলেও ৯৯ শতাংশ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলেরই মালিকানা ও সম্পাদনা একই পরিবার থেকেই আসে। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম আছে—কিছু কিছু মালিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ভালো সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সার্বিক মান খারাপ।
সরকার মনে করে, গণমাধ্যমকে ‘ম্যানেজ’ করা যাবে। কখনো কখনো তা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু মোটের ওপর গণমাধ্যম সরকারের হাতে পর্যুদস্ত। সাংবাদিকেরা নিজেরাই কর্তৃত্বের অংশ হয়ে হয়ে গেছেন। সম্প্রতি কয়েকজন সাংবাদিক টেপরেকর্ডে ধরা পড়েছেন মন্ত্রী নিয়োগ ও বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রাখতে গিয়ে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে গত তিন-চার দশকে বেশির ভাগ দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে সেই সব সাংবাদিকই গোনার মধ্যে পড়েন, যাঁদের সঙ্গে শাসকদের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.