বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-পার্লামেন্টের অধিকার ক্ষুণ্নম্ন করা যায় না by মনমোহন সিং

আমাদের সরকার নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সমর্থন করে। বস্তুত এ ধরনের কয়েকটি প্রতিবাদ অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যথাযথ শর্তারোপ করা থাকে এবং এসব শর্ত পূরণের অঙ্গীকার সংবলিত মুচলেকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে সংগঠকদের।

আন্না হাজারে এবং তার সমর্থকদেরও এসব শর্ত মেনে চলা ও এ ব্যাপারে মুচলেকাসাপেক্ষে অনশন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু তারা শর্ত মানতে ও মুচলেকা দিতে রাজি হয়নি বলে দিলি্ল পুলিশ তাদের প্রতিবাদ অনশন অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে।
লোকপাল বিল আদৌ প্রয়োজনীয় ও কাঙ্ক্ষিত কিনা_ এটা জাতির সামনে প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়। লোকসভার সব সদস্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকপাল বিল পাস করার বাপারে আগ্রহী। প্রশ্ন হলো, কারা আইনের খসড়া তৈরি করেন, আর কারাই-বা আইন প্রণয়ন করেন! স্বীকৃত রীতি হলো, নির্বাহীরা আইনের খসড়া প্রস্তুত করেন ও সেটা পার্লামেন্টে পেশ করেন এবং সংসদ এ নিয়ে বিতর্ক করে ও প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ ওই বিল সংসদ পাস করে। এই বিল পাসের প্রক্রিয়ায় আন্না হাজারে ও অন্যদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে তাদের মতামত জানানোর সুযোগ রয়েছে। স্পিকার বিলটি ইতিমধ্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠিয়েছেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সংসদ চাইলে এই বিলে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে। তবে কারও সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করার সাংবিধানিক অধিকারের দর্শন বা নীতি সম্পর্কে আমার জানা নেই। লোকপাল নিয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকার বিশ্বাসের সঙ্গে নির্ধারিত সব নিয়মনীতি অনুসরণ করেছে। আমার জানামতে, আন্না হাজারে এসব নিয়মনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং সংসদের ওপর তার প্রণীত লোকপাল বিল চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন।
আমি স্বীকার করছি, আন্না হাজারে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর লোকপাল প্রতিষ্ঠার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার প্রচারণা চালিয়ে থাকবেন। তবে লোকপালকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি যে পথ নিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত এবং আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।
আমাদের সরকার সমাজের কোনো অংশের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না। কিন্তু সমাজের কিছু অংশ যখন সরকারের কর্তৃত্ব ও সংসদের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন সরকারের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। রাজধানী শহরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য দিলি্ল পুলিশ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে, আন্না হাজারে ও তার সমর্থকদের গ্রেফতার ও পরে মুক্তি দেওয়া। আশা করি, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।
আমি এটা সুস্পষ্ট করতে চাই, আন্না হাজারের সঙ্গে সরকারের বিরোধটা দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির নয়। স্বাধীনতা দিবসে আমার ভাষণে আমি দুর্নীতি কার্যকরভাবে মোকাবেলার ব্যাপারে বিশদ আলোকপাত করেছি। আমি সংসদকে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল সরকার উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের হাতে এমন কোনো জাদু নেই যে, এক ফুৎকারে আমরা দুর্নীতিমুক্ত করে ফেলব। আমাদের যুগপৎভাবে বিভিন্ন ফ্রন্টে কাজ করতে হবে। আমি ইতিমধ্যে দুর্নীতি মোকাবেলার কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছি। দুর্নীতির ক্যান্সার মোকাবেলায় এই হাউসের সবাইকে একযোগে কাজ করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।
গতকালের ঘটনাবলি সত্ত্বেও আমি বলতে চাই, প্রায়োগিক গণতন্ত্রে বহু মত শুনতে হবে। তবে মতভিন্নতা সংলাপ ও কনসেনসাসের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে হবে। যারা মনে করেন, তাদের এবং তাদের মতামতেই ১২০ কোটি মানুষের মতামতের প্রতিফলন রয়েছে, তাদের উলি্লখিত পথ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার জন্য অনুরোধ করি। তাদের অবশ্যই যে সংসদ আইন প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হয়েছে, তাদের কাজ করতে দেওয়া উচিত।
ভারত একটি উদীয়মান অর্থনীতি। বিশ্বমঞ্চে আমরা এখন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছি। জাতিগুলোর মধ্যে ভারত মর্যাদাপূর্ণ আসন লাভ করুক_ এটা অনেকে চায় না। আমরা তাদের হাতের পুতুল হতে পারি না। অভ্যন্তরীণ বিবাদে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়_ আমরা তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারি না।
[ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ_ লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যের সারাংশ]

মনমোহন সিং : ভারতের প্রধানমন্ত্রী
 

No comments

Powered by Blogger.