সহজ কথার মানুষের কথা by বাবু মলিল্গক

সাতচলিল্গশের ১ জানুয়ারি রাজবাড়ী জেলার অজপাড়াগাঁ মূলঘরের কৃষক পল্লী ছাইবাড়িয়া গ্রামের এক আধা সামন্ত পরিবারে জন্মেছিলেন কমল গুহ। রাজবাড়ী কলেজ থেকে আইএ, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতক কমল গুহ ছেষট্টিতে হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা,

হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের মামলার আসামি। সাতষট্টিতে ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন সফল করতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি নিয়ে চষে বেড়ালেন সারাদেশ। ছাত্রজীবনেই পেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বীজমন্ত্র। পড়াশোনা শেষে রাজবাড়ী ফিরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরেক অগি্নপুরুষ, আন্দামান দ্বীপান্তরে কারাভোগকারী, ইংরেজের চর হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এবং রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলির নিশানা থেকে বেঁচে আসা কমরেড আশুভরদ্বাজ বহু বছর জেল খেটে সবে বেরিয়ে এসেছেন। কোটালীপাড়ার পৈতৃক জমিদারি বিলিয়ে দিয়ে তিনি পার্টির নির্দেশে তখন রাজবাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। তাকে সভাপতি করে গোয়ালন্দ মহকুমা ন্যাপের যে শাখা কমিটি গঠন করা হয়, তরুণ কমল গুহকে করা হলো তার সাংগঠনিক সম্পাদক। সে সঙ্গে পেশা জীবনে প্রথমে ফরিদপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা, পরে পাংশা কলেজে অঙ্ক শাস্ত্রে অধ্যাপনায় যোগ দেন।
একাত্তরের মার্চেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। ছাত্র-যুবকদের একত্র করে শুরু করেন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠ ও রাজবাড়ী মডেল হাইস্কুল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের তিনি হলেন অন্যতম সংগঠক। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত স্বাধীন বাংলা সংবাদপত্র 'উত্তাল পদ্মা'র সঙ্গে যুক্ত থেকে লিখলেন মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপ্ত কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর কমল গুহ আত্মগোপনে যান। জিয়ার সরকার তার পাসপোর্ট আটকে দিয়ে বল্গ্যাক লিস্টেড করল। রুচিবান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্বাধীনচেতা ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী কমল গুহ পাংশা কলেজের গভর্নিং বডির কিছু সদস্যের অনিয়মের প্রতিবাদে চাকরি ছেড়ে ওই বছরেই রাজবাড়ী উকিল বারে যোগ দিলেন। অল্প কিছুকালের মধ্যেই তিনি পরিচিত হলেন 'গরিবের উকিল' নামে।
সরাসরি সাংবাদিকতায় সংশিল্গষ্ট না থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের বিকাশ এবং লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার সঙ্গে কমল গুহের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে তিনি এই পত্রিকায় 'ভুসুকু' ছদ্মনামে নিয়মিত রাজনৈতিক কলাম 'সহজ কথা' লিখে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ওই জনপ্রিয় নামেই উত্তরকালে প্রকাশিত হয় রাজবাড়ী জেলার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক 'সহজ কথা'।
১৯৮৮-এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় রাজবাড়ীর বাগমারায় রাষ্ট্রপতি এরশাদের ঘোষণা 'কাউকে অনাহারে মরতে দেব না'_ চ্যালেঞ্জ করে সে বছর ১০ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে 'রাজবাড়ীতে ৯ দিন অনাহারে থাকার পর বৃদ্ধা আকিরুন্নেছার মৃত্যু' শিরোনামকৃত একটি সংবাদ প্রকাশ করায় এই নিবন্ধ রচয়িতাকে সমূহ বিপদ ও চরম ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কমল গুহ সাহসী উদ্যোগ না নিলে মফস্বলের এক ক্ষুদে সাংবাদিককে সেদিন কী ভাগ্যবরণ করতে হতো তা আজও অনুমান করলে গা হিম হয়ে আসে।
এরশাদের সামরিক শাসনামলে দু'বার বিশেষ ক্ষমতা আইনে কমল গুহকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৭ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েই তিনি বন্যার কবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। '৮৮-এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় তার মানবদরদি ভূমিকার কথা দলমত নির্বিশেষে রাজবাড়ীর মানুষ বহুকাল মনে রাখবে।
১৯৯০ সালে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চিকিৎসার জন্য কলকাতা পাঠানো হয়। তার এক সুহৃদ লিখেছেন : '... ১৮ আগস্ট শেষবারের মতো রাত ৮টা নাগাদ যখন দেখি তার সামান্য জ্ঞান আছে। নিঃশ্বাস টানতে দারুণ কষ্ট হচ্ছে। আমরা শঙ্কিত। সবিতা বৌদি নির্বিকার পাথরের মতো ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। কথা বলার বা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও মুখে নেই। রাত সাড়ে ১০টায় হাসপাতাল থেকে ফিরলাম। ভোর ৬টায় একজন ফোন করে জানালেন, কমল আর আমাদের মাঝে নেই। ১৯ আগস্ট কমলদার পার্থিব শরীর কেওড়াতলা মহাশ্মশান ঘাটে বৈদ্যুতিক চুলিল্গতে দাহ করা হলো। শোষিত-নিপীড়িত-লাঞ্ছিত মানবতার বন্ধু আমাদের সবার প্রিয় কমলদা তার নিজের জীবনকেই আদর্শ করে রেখে গেলেন। জন্ম এবং কর্মভূমির অগণিত বন্ধু-বান্ধব গুণমুগ্ধকে একবার শেষ দেখার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে একটা অসম্পূর্ণ জীবন অকালে ঝরে গেল।'
নব্বইয়ের ১৯ আগস্ট সকালে আকাশবাণীর খবরে কমরেড কমল গুহের অকাল প্রয়াণের এই দুঃসংবাদ শুনে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ বছর তার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শত-সহস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সধষষরশ.নধনঁ৬@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.