সরল গরল-জ্যৈষ্ঠের অপ্রকাশিত দলিলগুলো by মিজানুর রহমান খান

সরকার ও বিরোধী দল যে ইস্যুতে এখন মুখোমুখি, সেখানে তাদের অবস্থান কাছাকাছিও বটে। এর প্রমাণ দিতেই এই লেখা। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংস্কারের যে রূপকল্প দিয়েছিলেন, তা বিশেষ কমিটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করেছিল বলে আমরা বিশ্বাস করি। খবরের পেছনে খবর থাকে।

সংবিধানের আরও কতিপয় প্রস্তাবিত সংশোধনীর কথা আমরা জেনেছি, যা নিয়ে পর্দার আড়ালে আলাপ-আলোচনার দাবি রাখে। আদালতের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন দল যে ভুল করেছে, সেটা শোধরানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রথমেই বলে নিই ৩৬ ঘণ্টা হরতাল উদ্রেককারী ইস্যুতে বিশেষ কমিটির ভাবনা।
‘৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে। পদত্যাগী মন্ত্রিসভা পুনরুজ্জীবিত হবে। এবং তারা তখন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।’
গত ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের মাত্র চার দিন আগেও বিশেষ কমিটি এভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশসংবলিত খসড়া প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিল।
প্রথম আলোর সংগ্রহে বিশেষ কমিটির দুটি খসড়া প্রতিবেদন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের এমনকি ২৪ ঘণ্টা আগে সংশোধিত খসড়ায়ও দেখা যায়, কমিটি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটিসূত্রের ব্যাখ্যা এ রকম: ‘ওটা বাঁচাতে সরকারের সিদ্ধান্ত তো ছিলই। কিন্তু আদালতের রায়ের কারণে তা বাদ দিতে হয়েছে।’ কিন্তু আপিল বিভাগ গত ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী ‘ভবিষ্যৎ সময়ের জন্য’ বাতিল বলে রায় দেন। বিশেষ কমিটির ওই দুটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরির তারিখ যথাক্রমে ২৬ ও ২৯ মে ২০১১।
২৮ মে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ কমিটির ২৬তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কমিটির সভাপতি হয়েও তিনি বলছেন, ‘আশা করি, ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা আমাদের কাজ শেষ করে মাননীয় নেত্রীর কাছে পেশ করব।’ ফজলে রাব্বি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আমির হোসেন আমু প্রমুখের অবস্থান ছিল: রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ ও তত্ত্বাবধায়ক—এই তিনটি বাকি রেখে এ বিষয়ে ‘মাননীয় নেত্রী যেটা করবেন, সেটা আমরা মেনে নেব’।
আমাদের জানামতে, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আবদুল মতিন খসরু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রেখে তা সংশোধনের পক্ষে ছিলেন।
সংসদের নেতা শেখ হাসিনার প্রস্তাবক্রমে গত বছর সংসদে সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। সরকারি দল বলেছিল, পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধনকল্পে বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে। এ জন্য সংবিধান পুনর্মুদ্রণের জন্য তাদের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছিল। অথচ সাজেদা চৌধুরীর সংসদে উত্থাপিত প্রতিবেদন সাক্ষ্য দিচ্ছে, ওই কমিটির কার্যবিধিতে কোনো আদালতের রায়ের কথাই বলা হয়নি। বরং তিনি বলেছেন, আদালতের কয়েকটি রায় কমিটি বিবেচনায় নিয়েছে। সুতরাং কমিটির এই প্রতিবেদনই প্রয়োজনে আদালতেও সাক্ষ্য দেবে যে আদালতের রায়ের কারণে কমিটি ত্রয়োদশ সংশোধনী বিলোপের সুপারিশ করেনি। যদিও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা মুখে অমনটাই দাবি করছেন। কমিটির প্রতিবেদন ও আদালতের সংক্ষিপ্ত রায় সাংঘর্ষিক নয়।
পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে গঠিত বিশেষ কমিটি প্রধানত সরকারি বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করেছিল। আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলে গঠিত বিশেষ কমিটি ৪৫টি বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২৫টি প্রতিবেদন সংসদে পেশ করেছিল। কিন্তু কখনোই বিশেষ কমিটির বৈঠকের আগে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি। এবার যেটা ঘটেছে, সেটা নজিরবিহীন ও সংসদীয় রীতিনীতির পরিপন্থী। সে কারণে কমিটির সদস্যরা সংসদ-নেতার সঙ্গে তাঁদের বৈঠকটি নিয়ে বেকায়দায় আছেন।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আমাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কারণেই আমরা অবস্থান বদল করিনি। তিনি কিছু করতে চাইলে তা মন্ত্রিসভায়ও পারবেন। তাঁর সঙ্গে বৈঠকটি “অনানুষ্ঠানিক” ছিল।’
২৭ এপ্রিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কমিটির আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। তখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন। তখনো রায় হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘না’-এর পরেই বিশেষ কমিটির অবস্থান বদলের ঘটনা প্রকাশ্য। এর দালিলিক প্রমাণও পাচ্ছি। কখনো এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হলে সংসদ-নেতাকেও বলতে হবে, রায় ব্যাখ্যায় তিনি ‘অনানুষ্ঠানিক’ মত দিয়েছিলেন মাত্র।
২৬ মের খসড়া: এই তারিখে তৈরি প্রতিবেদনের ২১ দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে জরুরি অবস্থা ও অধ্যাদেশ জারি করতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রহিতের সুপারিশ ছিল। এ ছাড়া ৫৮খ অনুচ্ছেদে বিধান করা হয় যে নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘নির্দলীয় সরকার বিলুপ্ত হইবে এবং পূর্ববর্তী সংসদের মেয়াদ অবসানের অব্যবহিত পূর্বে এবং অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করিবে।’ এমনকি ৫৮ঘ অনুচ্ছেদে নতুন(৩) দফা যুক্ত করা হয় যে ‘নির্দলীয় সরকার কোন রাষ্ট্র, দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে কোনো প্রকারের চুক্তি সম্পাদন কিংবা ইতিপূর্বে সম্পাদিত কোনো চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করিবেন না।’ বিএনপি নির্দিষ্টভাবে এই খসড়ার ভিত্তিতে একটা পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দিতে পারে। ওই প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা ছিল না যে অন্তর্বর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে।
এটাও লক্ষণীয় যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের এক দিন আগে ২৯ মে প্রস্তুত খসড়ায় কমিটি শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল ৯০ দিন নির্ধারণ করে একটি নিতান্তই নির্দোষ সুপারিশ এনেছিল। এই প্রতিবেদনটিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো হয় বলে জানি। এতে শুধু ৫৮খ অনুচ্ছেদের সংশোধন চেয়ে বলা হয়েছিল, ‘৫৮খ-এর দফা (১)-এ “মেয়াদে” শব্দের পর “অনধিক ৯০ দিনের জন্য” শব্দগুলি সন্নিবেশিত হইবে।’
এবারে আসা যাক ধর্মসহ অন্যান্য প্রসঙ্গে।
ধর্ম: খসড়া প্রতিবেদনে রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত ২(ক) অনুচ্ছেদের তিনটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন আগের মতোই ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ টিকে আছে। কিন্তু ২৯ মে প্রস্তুত খসড়ায় তিনটি বিকল্প ছিল। প্রথমত, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মও রাষ্ট্রধর্মের সমমর্যাদা ও সম-অধিকার পাইবে।’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখানে অটল ছিলেন। মেননের প্রস্তাব ‘প্রজাতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম। একই সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগণও রহিয়াছেন। প্রজাতন্ত্র সকল ধর্মের সম-অধিকার নিশ্চিত করিবে।’ সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর প্রস্তাব: ‘প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ স্ব স্ব ধর্ম পালনে সমমর্যাদা ও সম-অধিকার পাইবে।’ আমরা মেনন ও খসরুর মত সমর্থন করি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ‘রাষ্ট্রধর্মের সমমর্যাদা’ কথাটি শুধু সমর্যাদায় রূপ নেয়। অন্যান্য ধর্ম রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা হারায়। বর্তমান অবস্থাটিকে অগ্রজ সোহরাব হাসান তাঁর শনিবারের কলামে যথার্থই ‘অদ্ভুত ওরস্যালাইন’ হিসেবে গণ্য করেছেন। তবে এ বিষয়ে একটি রিট হয়েছে।
৭০ অনুচ্ছেদ: সরকারের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব বা সরকারের বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অর্থ আইন ও নির্দিষ্টকরণ আইন প্রণয়নে কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কোনো আইন প্রণয়নে বাধা দিয়ে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। ৩০ মের পরে প্রস্তুত চূড়ান্ত খসড়ায় এরও বিলোপ ঘটে। ফিরে এসেছে অবশ্য বাহাত্তরের সত্তর অনুচ্ছেদ। তদুপরি কমিটির ওই ‘আপস’ মার্জনা করা যায় না।
সার্কিট বেঞ্চ: জেনারেল এরশাদের আমলে আনা বিতর্কিত অষ্টম সংশোধনীতে সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ছয়টি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের একটি করে স্থায়ী বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তা বাতিল হয়েছিল। ২৯ মের খসড়া প্রতিবেদনে রাজধানীর বাইরে প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে অনধিক ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চের অধিবেশন অনুষ্ঠান কিংবা প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চের অধিবেশন প্রতিবছর অন্যূন দুই মাসের জন্য অনুষ্ঠানের একটি অতীব প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা বাদ পড়ে। মনে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে গিয়ে সেখানে সার্কিট বেঞ্চ গঠনে একটি অঙ্গীকার করেন। তাঁর প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয় ঘুরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে যায়। বিচার বিভাগীয় কোটারি কত ভয়ানক হতে পারে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান তার একটি নমুনা। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফুলকোর্টে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওই চিঠিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কার্যত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। মেরিটে নয়, টেকনিক্যাল প্রশ্নে ওই প্রশ্নে নাকচ করা হয় বলে আমরা জানি। কোটারি স্বার্থ রক্ষার বৃত্তান্ত এখানেই শেষ নয়।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল: জেনারেল আইয়ুব ১৯৬২ সালে সামরিক ফরমান দিয়ে এই বিধান পাকিস্তান সংবিধানে ঢোকানোর ১৫ বছর পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দিয়েই বাংলাদেশে তা আমদানি করেন। তবে বিচারক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা দলীয়ভাবে বিভক্ত হলেও এই ব্যবস্থা বজায় রাখতে তাঁদের শ্রেণীগত ঐক্য দেখা যায়। বাহাত্তরের সংসদীয় অভিশংসন পুনর্বহালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট মহল ‘সর্বদলীয়রূপে’ এর বিরোধিতা করেন। এ অবস্থায় কমিটি একটি মাঝামাঝি অবস্থান নেয়। কমিটির বড় অর্জন ছিল, প্রথমবারের মতো তারা বিচারিক অদক্ষতাকেও অপসারণযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
বর্তমানে বিচারক অপসারণে কাউন্সিলের সুপারিশই শেষ কথা। কমিটি উদ্ভাবন করেছিল, বিচারক অপসারণে কাউন্সিলের সুপারিশের পরে প্রধানমন্ত্রীর অটোমেটিক সম্মতি শেষ নয়। বিচারক অপসারণের কর্তৃত্ব আগের মতোই সুপ্রিম কোর্টের কাছে থাকবে। তবে তাঁদের সুপারিশ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত হতে হবে। কমিটি অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মরত বিচারপতিদেরও মতামত শুনেছিল। তাঁরা নাকি কমিটির নতুন সুপারিশের সঙ্গে একমতও ছিলেন।
কমিটির উদ্ভাবন আমরা সমর্থন করি। বর্তমানে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী দুজন কর্মে প্রবীণ অর্থাৎ শুধু আপিল বিভাগের তিন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নিয়ে কাউন্সিল গঠিত। কিন্তু কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে তা পুনর্গঠনের সুপারিশ ছিল। বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রত্যেক বিভাগ হইতে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত দুইজন করিয়া মোট চারজন বিচারক এবং স্পিকার কর্তৃক মনোনীত দুইজন সংসদ সদস্য লইয়া উক্ত কাউন্সিল গঠিত হইবে।’ ৩০ মের ওই বৈঠকের পর এরও বিলোপ ঘটে। পঞ্চম সংশোধনীর স্রষ্টা জেনারেল জিয়ার প্রতি হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাহাত্তরের সংবিধান সমাহিত হয়। বিশেষ কমিটি তথা এই সংসদ ২০১১ সালে এসে কীভাবে কত ব্যাপকতায় জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ বলেছে, তার একটা বিস্তারিত ফিরিস্তি আমরা পরে লিখব, না হলে আমাদের স্ববিরোধী রাজনীতির চরিত্রচিত্রণ যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে!
১১৬ অনুচ্ছেদ: আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীসহ অন্তত তিনটি রায়ে অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়ে আনতে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। বাহাত্তরে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণভার শুধু সুপ্রিম কোর্টের কাছেই ন্যস্ত ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে তা নেওয়া হয়েছিল সরকারের হাতে। সেটাই চলছিল, জিয়া সেখানে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ সংযোজন করেছিলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি, বিশেষ কমিটির বাহাত্তরে ফিরতে রুচি হয়নি, রুচি ধরেছে সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে জিয়াকেই কুর্নিশ জানাতে। আসুন, এই হরতাল কিংবা ভয়তালের মধ্যে আমরা আরেকবার বলি, জেনারেল জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ! এই আম-কাঁঠালের জ্যৈষ্ঠ আরও রসময় হোক, এর মধুর রসে রুদ্র পরিবেশটা আরও রসসিক্ত হোক! সত্যি, কমিটির অপ্রকাশিত অম্লমধুর দলিলগুলো আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যের জন্য কী তাৎপর্যপূর্ণ! এর প্রায় সবটাই কী স্বচ্ছ, রসে টইটম্বুর! এর কাছে ল্যাংড়া কিংবা হিমসাগর কোনোটাই টেক্কা দিতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, এখানেও আশাবাদের গল্প আছে। বিশেষ কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরে ফিরিয়ে নেওয়ার সুপারিশও ছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাইলে বাহাত্তর অবশ্যই অপরিহার্য।
শেষ কথা: তাই আমরা মনে করি, বিশেষ কমিটির খসড়া প্রতিবেদনগুলোও সংরক্ষণ করা হোক। এসবই হতে পারে সমঝোতা সূত্র। এগুলো পেতে পারে সাংবিধানিক দলিলের ঐতিহাসিক মর্যাদা। দোহাই, কারও মুখরক্ষায় এগুলো ধ্বংস করবেন না। কারও ইচ্ছায় কমিটি মত পাল্টাল কি না, সেটা গৌণ, কমিটির স্বাধীনতা কত দূর ব্যাপ্ত হয়েছিল তার স্বীকৃতি ও তার রেকর্ড রাখাই ইতিহাসের দাবি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.