জনজীবন-‘বাজেট আসে কষ্ট বাড়াইতে’ by মশিউল আল

রাজধানীর আদাবরে বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটিতে ঢোকার মুখে ওষুধের একটি ছোট্ট দোকান: নাদিয়া মেডিকেল স্টোর। এর মালিক সানাউল্লা নওশাদকে (৪০) জিজ্ঞেস করা হলো: ‘আপনার সংসারের মাসিক বাজেট কত?’ অদোকানদারসুলভ সলজ্জ হাসি: ‘তা তো বলতে পারি না!’ এর মানে এটা নয় যে স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তাঁর ছোট্ট

পরিবারের জীবন ধারণের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। দিনে বিক্রি হয় কত টাকার ওষুধ? আট থেকে দশ হাজার টাকার। লাভ? ৭০০ বা সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ মাসিক গড় আয় ২১ থেকে ২৩ হাজার টাকার মধ্যে। আর মাসে গড় সংসার-খরচ? ৩৩ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। মানে, নওশাদের সংসারে মাসিক বাজেট ঘাটতি গড়ে ১২ হাজার টাকা। প্রতি মাসের এই ঘাটতি পূরণ হয় কীভাবে? নওশাদ জানালেন, তিনি ভাগ্যবান যে তাঁর ভাইবেরাদর ও ভগ্নিপতিরা তাঁকে সহযোগিতা করেন।
এবার জিজ্ঞাসা করা হলো: ধরা যাক, আজ থেকে এক বছর আগে কেমন ছিল আপনার সংসারের আয়-ব্যয়? আয় কম ছিল, বেড়েছে হাজার তিনেক টাকা। বেড়েছে এ জন্য যে দৈনিক যে পরিমাণ ওষুধ এক বছর আগে বিক্রি হতো, এখন তার চেয়ে বেশি হয়। কিন্তু দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় মোট খরচ বেড়েছে ছয় হাজার টাকার মতো। ঘাটতি হলো তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ নওশাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। তিনি আগের চেয়ে দরিদ্র হয়েছেন।
দুই. নোয়াখালীর মফিজউল্লাহ (৪২) ছোটখাটো চাকরি করতেন চট্টগ্রামের আর আর টেক্সটাইল মিলে। বছর পাঁচেক আগে মিলটি বন্ধ হলে তিনি বেকার হয়ে পড়েন। তারপর জীবিকার সন্ধানে আসেন রাজধানী ঢাকায়। কাজ মেলে না। তৃষ্ণা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের বারান্দায় বিক্রি করেন পান-সিগারেট, গুল, লেবেঞ্চুস ইত্যাদি। দিনে গড় আয় ৩০০ টাকা, মাসে নয় হাজার। মেসে থাকেন, সিট ভাড়া এক হাজার টাকা। খাওয়া-খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে মাসের খরচ আরও সাড়ে চার হাজার। এই একলা মানুষটির জীবনধারণের মাসিক খরচ গড়ে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। হাতে থাকে আড়াই হাজার। এই টাকাটা তিনি পাঠিয়ে দেন গ্রামে, যেখানে বাস করেন তাঁর স্ত্রী এবং ছোট ছোট তিনটি সন্তান। এই সামান্য অর্থে তারা কী খায়, কী করে চলে? মফিজউল্লাহ বললেন, ‘আল্লায় চালায়।’ স্মিত হেসে আবার যোগ করলেন, ‘চাকরিটা যখন গেল, দুই লাখ টেহা পাইছিলাম, হেইডাই ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা চলতাছে। অখন হেই টেহাও ফুরায়া আইছে।’ ‘পুরোটা ফুরিয়ে গেলে?’ বললেন, ‘আল্লাহ আছে না? রিজিকের মালিক তো আল্লাই!’ ‘গত এক বছরে আয় কিছু বাড়েনি আপনার?’ ‘পাই পইসাও বাড়েনি। উল্টা খরচ বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের দাম কেমুন সব বাইড়্যা গেছে, দেখেন না? বাসের ভাড়া বাড়াইল, চলাফিরাই করবার পারি না। আর রেশকায় তো উঠনই যায় না। পাঁচ ট্যাকার ভাড়া হইছে দশ-বারো ট্যাকা।’ অর্থাৎ ওষুধবিক্রেতা নওশাদের মতো পান-সিগারেটবিক্রেতা মফিজউল্লাহও আগের চেয়ে গরিব হয়েছেন।
তিন. জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার করিমপুর গ্রামের মনির হোসেন (৩৬) ঢাকা মেট্রোপিলটন পুলিশের কনস্টেবল। স্ত্রী ও দুটি শিশু মেয়ে নিয়ে থাকেন পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া একটি বাসায়। বেতন-ভাতা মিলিয়ে মোট মাসিক আয় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। জানালেন, এই টাকায় তাঁর সংসার চলে না। তাহলে কীভাবে চলে? বললেন, ‘গ্রামে বিঘা আষ্টেক জমি আছে, ছোট ভাই চাষবাস করে। চাল আর আলু গ্রাম থেকে নিয়ে আসি। তা ছাড়া চলতই না।’ জানালেন, এক বছর আগে পোস্টিং ছিল দিনাজপুরে, সেখানে একটু ভালো ছিলেন, কিন্তু ঢাকায় এসে অর্থকষ্ট বেড়েছে এবং ক্রমেই আরও বাড়ছে।
চার. ভোলার মানুষ আবদুর রব (৩২)। ঢাকার পীরেরবাগে এক রুমের একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে বাস। বড় সন্তান (৮) স্কুলে যায়, ছোটটি (৫) এখনো যেতে শুরু করেনি। আবদুর রব কালো রঙের ট্যাক্সি চালান। ট্যাক্সির মালিককে দৈনিক দিতে হয় ৭০০ টাকা। হাতে থাকে গড়ে শ-চারেক টাকা। ট্যাক্সি প্রতিদিন চালাতে পারেন না, গড়ে মাসে পনেরো দিন চালান। বললেন, শরীরে কুলায় না। মাসিক আয় সাড়ে চার হাজার টাকা। বাসা ভাড়া ১৬০০ টাকা। হাতে থাকে তিন হাজার টাকারও কম। খাওয়া-দাওয়া, সংসারের অন্যান্য খরচ চলে কী করে? আবদুর রব জানালেন, তাঁর স্ত্রী একটি ছাপাখানায় কাজ করে মাসে আড়াই হাজার টাকা পান। এই দিয়ে টেনেটুনে চলে যায়। জানালেন, আগে ইটভাটার শ্রমিক ছিলেন, পরিশ্রম বেশি, মজুরি কম বলে ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালানো শুরু করেন। এই কাজে আয় বেশি, কিন্তু মেহনত তার চেয়ে অনেক বেশি। একদিন রিকশা চালালে পরদিন আর শরীরে কুলোত না। তাই সিএনজি চালানো শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং কষ্ট হচ্ছে। শুধু থাকা-খাওয়ার পেছনেই খরচ হয়ে যায় সবটুকু আয়; অসুখ-বিসুখ করলে আয় তো বন্ধই, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বা ওষুধ কেনার সামর্থ্যও থাকে না।
পাঁচ. রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ফেরদৌস আরা চাকরি করছেন ২৫ বছর। বর্তমানে মূল বেতন ২৬ হাজার ৫০ টাকা, সব মিলিয়ে হাতে পান ৪৫ হাজার টাকার মতো। তাঁর তিনটি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। জানালেন, গত এক বছরে তাঁর বেতন বেড়েছে ৯০০ টাকা; কিন্তু খরচ বেড়ে গেছে ছয়-সাত হাজার টাকা। কস্ট বেড়েছে অনেক। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, চলাচলের খরচ বেড়েছে, কাজের বুয়ার মজুরি বেড়েছে, ডাক্তারের ফি বেড়েছে—কিসের দামটা বাড়েনি? খেদোক্তি করলেন ফেরদৌস আরা।
ছয়. এই পাঁচজন মানুষের সংসারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বাড়ার বিবরণে নতুন কোনো আবিষ্কার নেই। আয়ের চেয়ে ব্যয় অসংগতিপূর্ণ হারে বেড়ে যাওয়ায় সিংহভাগ মানুষেরই কম-বেশি এমন অবস্থা। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা বলছে, মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশে গত এক বছরে ২৫ লাখ মানুষ (মোট জনসংখ্যার দেড় শতাংশের কিছু বেশি) আগের চেয়ে গরিব হয়েছে; তাদের অবস্থান নেমে গেছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। ২০১৫ সালের মধ্যে আমরা মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হব—এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে দারিদ্র্যায়নের এই যে উল্টো স্রোত শুরু হয়েছে, তা কীভাবে ঠেকানো সম্ভব? সরল হিসাব বলে, এটা ঠেকানো যেতে পারে কর্মসংস্থান বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রয়োজন বিনিয়োগ বাড়ানো। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে নতুন অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন, তাতে কী এমন পরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থা রয়েছে, যার ফলে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে? বাজেটে সব সময়ই এ রকম প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি থাকে, কিন্তু বাস্তবে কর্মসংস্থান খুব বেশি বাড়ে না। যে কজন মানুষের সঙ্গে কথা হলো, তাঁরা বাজেটের এত কিছু বোঝেন না। তাঁদের কাছে বাজেট একটাই বার্তা বয়ে আনে: জীবনযাত্রা আরও কঠিন হবে। ব্যাংক কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বললেন, সরকার বাজেট করার সময় চিন্তা করে দেখে না কী করলে জনগণের ভালো হবে, কী করলে মন্দ হবে। তারা তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো বাজেট তৈরি করে; কারণ জনগণের দুঃখ-কষ্টের দিকে তাদের কোনো নজর নেই। ওষুধবিক্রেতা নওশাদের মন্তব্য, ‘বাজেট কোনো সুখবর নিয়ে আসে না।’ পান-সিগারেটবিক্রেতা মফিজউল্লা বলেন, ‘বাজেট দিলেই দেখি “দ্রব্যমূল্যের দাম” বাড়ে।’ সিএনজিচালক আবদুর রব মলিন হেসে বলেন, ‘বাজেট আসে আমাগো কষ্ট বাড়াইতে।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.