সমকালীন প্রসঙ্গ-জাতীয় সংসদ সমাচার by বদরুদ্দীন উমর

জাতীয় সংসদ কোনো ফালতু সভাকক্ষ নয়। এটা হলো জাতির গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আলোচনা এবং সেসব বিষয় সিদ্ধান্ত নেওয়া। আইন প্রণয়ন করার জায়গা। কিন্তু দেখা যায় আইনের পর আইন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী তিন মিনিটে পাস করলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না।

অবস্থা দেখে মনে হয়, এই সংসদ একটা খিস্তিখেউরের জায়গা ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলেও খিস্তিখেউর চলে এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও বিরোধী দল উপস্থিত থাকলে এই খিস্তিখেউর জমে আরও ভালো। মূর্খ, অর্ধশিক্ষিত ও নৈতিকভাবে অধম লোকদের হাতে পড়ে একটি দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পরিষদের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হলো তার এক বড় দৃষ্টান্ত

নিজেদের সংসদ সদস্যপদ যাতে না হারায় এ জন্য নির্ধারিত অনুপস্থিতির দিন শেষ হওয়ার আগেই তারা জাতীয় সংসদে যোগদান করে নিজেদের সদস্যপদ ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই বিরোধী দলে থাকার সময় কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে সংসদ বয়কট করে এসেছে এবং অনুপস্থিতির নির্ধারিত মেয়াদ পার হওয়ার আগে বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে সংসদে যোগদান করে আবার কোনো না কোনো ছুতোয় সংসদ ত্যাগ করে বসে থেকেছে! এই অনৈতিক এবং তাদের ওপর জনগণের অর্পিত আস্থা ভঙ্গকারী কাজ করতে এ দুই দলের কোনোটিরই অসুবিধা হয়নি। সংসদে সরকারি দল তাদের কথা বলতে দেয় না, এই কথা বলে তারা সংসদে অনুপস্থিত থাকলেও সংসদ সদস্য হিসেবে তারা নিজেদের পাওনা কড়ায় গণ্ডায় ঠিক বুঝে নেয়। মাসিক ভাতাসহ হাজার রকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা প্রত্যেকে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করেন। এ কাজ যে জনগণের কাজ না করে তাদের পকেট মারার শামিল এটা তাদের কারও মনে হয় না। ভোট দিয়ে জনগণ তাদের জাতীয় সংসদে পাঠান নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু সংসদ সদস্যদের আচরণ দেখে মনে হয় না যে, এ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনাচিন্তা অথবা নৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা আছে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে ঘৃণ্য ব্যাপার এই যে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক তারা জোর গলায় বিরোধীদের সমালোচনা এমনভাবে করে, যাতে মনে হয় তারা নিজেরা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এ কাজ করেনি!
প্রায় এক বছর অনুপস্থিত থাকার পর বিএনপি ১৮ মার্চ সংসদে যোগ দিয়েছে সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে তাদের প্রস্তাব উপস্থিত করার কারণ দেখিয়ে। জাতীয় সংসদ এমন এক সভাকক্ষ যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যোগদানের জন্য কোনো কারণ দেখানোর প্রয়োজন হয় না। এটা হয় না, কারণ সংসদে উপস্থিত থাকার জন্যই জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে থাকেন। কাজেই সেখানে উপস্থিত থাকা তাদের রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এ কথা সত্য হলেও বাংলাদেশ এমনই এক ভূখণ্ড যে এখানকার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এমনই চারিত্রিক অবস্থা যে, তারা এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার কোনো প্রয়োজনবোধ করে না।
এই দুই দলই তার ক্ষমতাসীন বিরোধী পক্ষকে বলে যে, তারা দেশকে জমিদারির মতো করে পরিচালনা করে। তাদের শাসন কাজ ও কথাবার্তার ধরন দেখে সেটাই মনে হয়। গদিতে বসে তারা মনে করে যে, তারা জমিদারির আসনে বসেছে! নির্বাচনে গদিচ্যুত হয়ে তারা মনে করে, অন্য পক্ষ তার জমিদারি অন্যায়ভাবে দখল করেছে! এ কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক হানাহানির সঙ্গে জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক থাকে না। 'জমিদারি' রক্ষা ও 'জমিদারি' পুনরুদ্ধারের এই চেষ্টার সঙ্গে জনগণের কোনো ধরনের স্বার্থের যোগ সম্পর্ক থাকার প্রশ্ন ওঠে না।
জাতীয় সংসদ কোনো ফালতু সভাকক্ষ নয়। এটা হলো জাতির গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আলোচনা এবং সেসব বিষয় সিদ্ধান্ত নেওয়া। আইন প্রণয়ন করার জায়গা। কিন্তু দেখা যায় আইনের পর আইন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী তিন মিনিটে পাস করলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। অবস্থা দেখে মনে হয়, এই সংসদ একটা খিস্তিখেউরের জায়গা ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলেও খিস্তিখেউর চলে এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও বিরোধী দল উপস্থিত থাকলে এই খিস্তিখেউর জমে আরও ভালো। মূর্খ, অর্ধশিক্ষিত ও নৈতিকভাবে অধম লোকদের হাতে পড়ে একটি দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পরিষদের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হলো তার এক বড় দৃষ্টান্ত।
গতকাল ১৮ মার্চ বিএনপি জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়ার পর লোকে জাতীয় সংসদের দৌড় কত দূর তা জানা সত্ত্বেও মনে করতে পারত যে, ওই দিন সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুতর আলোচনা হবে। কিন্তু তার তো উপায় নেই। আওয়ামী লীগের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য সাংবাদিক মহল থেকে নিয়ে সব রকমের জনগোষ্ঠী যখন কর্মসূচি উপস্থিত করছে, তখন তারা এসব থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে রাখার জন্য ধুয়োর মতো করে বলছে যে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনের সময় পাকিস্তানের আইএসআইর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন, তিনি পাকিস্তানের দালাল এবং তার উচিত এ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়া। এটা বোঝার অসুবিধা নেই যে, খালেদা জিয়া এ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে গেলে শেখ হাসিনার বড়ই সুবিধা হয়। কিন্তু তিনি কেন এ কাজ করবেন? এ দেশ তো কারও পারিবারিক জমিদারি নয়। দেশের লোকে শেখ হাসিনাকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি করেছেন কিন্তু দেশের জমিদার তো বানাননি। কাজেই দেশের কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধেই এভাবে কথা বলার কোনো অধিকার শেখ হাসিনার নেই, যেমন সে অধিকার খালেদা জিয়ারও নেই। কিন্তু জমিদারি কায়দায় হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যেমন একদিকে লাঠিয়াল দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে 'শায়েস্তা' করার কাজ করছেন, তেমনি তিনি তার বিরোধীদের হুকুম দিচ্ছেন দেশ ছেড়ে অর্থাৎ তার চিন্তা অনুযায়ী তার জমিদারি ছেড়ে চলে যেতে!
১৮ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনের কথায় ফিরে এলে দেখা যায় যে, রীতি অনুযায়ী সেখানে খিস্তিখেউরের রাজত্বই কায়েম হয়েছে। খালেদা জিয়া আইএসআই থেকে টাকা খেয়েছেন, এটাই ওই দিন জাতীয় সংসদের প্রধান, বলা চলে একমাত্র আলোচনার বিষয়! কাজেই খালেদা জিয়া কর্তৃক পাকিস্তানের আইএসআই থেকে টাকা খাওয়া এবং শেখ হাসিনা কর্তৃক লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকায় উলি্লখিত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর কাছ থেকে টাকা খাওয়ার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও তা নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক এবং হাতাহাতির অবস্থা ছাড়া সেখানে আর কিছু ছিল না। এমনকি এই তর্কবিতর্ক ও খিস্তিখেউর এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল তার দ্বারা উভয় পক্ষের দুই মহিলা সাংসদ পরস্পরের ওপর শারীরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন! লেডি গুণ্ডার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছেন পরিস্থিতি ঘোরতর হলে মেয়েরাও গুণ্ডামিতে পিছিয়ে থাকেন না! পুরুষদের থেকে তারা কম নন! এসব কথা বলার মধ্যে কোনো সুখ নেই। কিন্তু এটা এ দেশের জনগণের দুর্ভাগ্য যে, তাদের এসব দেখতে হয় এবং এর বিরুদ্ধে কথা বলা তাদের দিক থেকে প্রয়োজন হয়। কারণ, সংসদের অভ্যন্তরে এই ধরনের আচরণের দ্বারা দেশের ও জনগণের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। জাতীয় সংসদের এখন এমনই অবস্থা যে, কয়েকদিন আগে সরকারের অর্থমন্ত্রী অর্থ বিষয়ক এক রিপোর্ট সংসদে পেশ করতে থাকার সময় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিষোদ্গার করতে থাকার সময় আওয়ামী লীগ সরকারের একান্ত অনুগত স্পিকারকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে তাকে বলতে হয় অপ্রাসঙ্গিক গালিগালাজ বন্ধ করে নিজের বক্তব্য বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে! তিনি আরও বলেন যে, অর্থমন্ত্রী সংসদের সব থেকে প্রবীণ অর্থাৎ বুড়ো সদস্য হয়ে এ ধরনের আচরণ মোটেই শোভনীয় নয়। স্পিকারের এই হস্তক্ষেপে অর্থমন্ত্রী গালিগালাজে ক্ষান্ত হলেও সংসদ সদস্যরা শোভনীয় আচরণ করবেন এমন ভরসা একেবারেই নেই। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান এখন মূর্খ, অর্ধশিক্ষিত, নিম্নসংস্কৃতিসম্পন্ন এবং অধম চরিত্রের লোকদের দ্বারাই দখল হয়েছে। এদের আশি-নব্বই ভাগই ব্যবসায়ী অথবা ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষক। কাজেই এ পরিষদের যে অবস্থা স্বাভাবিক সেটাই এখন দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে সেটা থেকে নিয়ে কোনো সমস্যার সমাধানই এই সংসদে পাওয়া যাবে এটা মনে করাও এক অবাস্তব ব্যাপার। এই অবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া করার আর কী আছে!
১৯.৩.২০১২

No comments

Powered by Blogger.