ছারপোকা, পঙ্গপাল এবং যানবাহন by মিনার মাহমুদ

যুদ্ধের প্রয়োজনে আবিষ্কৃত হয় নানাবিধ বিজ্ঞান, নতুন নতুন প্রযুক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে 'পারমাণবিক' বোমা ছিল আমেরিকার সব থেকে 'অমানবিক' আবিষ্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অযথা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পূর্ব ভিয়েতনামের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশের সঙ্গে মহাসমর শক্তির আমেরিকা ওরফে প্রেসিডেন্ট- পেন্টাগন।

৫০টি রাজ্যের 'বিশ্ববিদ্যালয়'গুলোতে চলতে থাকে বিস্তর গবেষণা। এক দল পেল ছারপোকার অসাধারণ প্রতিভা। অন্য কোনো প্রাণী না, শুধু মানুষের উপস্থিতি এরা বুঝতে পারে, দূূর থেকেই। তখনই নিজেদের ভেতর 'শব্দ' সংকেত বিনিময় করে এরা, উত্তেজিতভাবে। নাপাম বোমা বি-৫২ বিমান, অজস্র মার্কিন সৈন্য; কিছুতেই যখন সুবিধা হচ্ছিল না ভিয়েতনামে, তখন ছারপোকাভর্তি 'ক্যাপসুল' ফেলে আসা হতো জঙ্গলে। জঙ্গল ছিল স্বদেশভূমির জন্য যুদ্ধরত 'ভিয়েতকঙ' বাহিনীর একমাত্র গেরিলা ঘাঁটি। 'ছারপোকা' থেকে প্রাপ্ত সংকেত লক্ষ্য স্থির করে নিকটতম বেজ থেকে রাতের অন্ধকারে 'চেরোকি' হেলিকপ্টার চালাত ভারী আর্টিলারি।
অনুমান করে নেওয়া যায়, পেন্টাগন সেই যুদ্ধে আণবিক বোমা ব্যবহার করেনি মানবিক কারণে নয়। নিতান্তই চক্ষুলজ্জায়। কেননা ততদিনে হিরোশিমা-নাগাসাকির ক্ষত স্পর্শ করেছে বিশ্ববিবেককে। মানুষ যুদ্ধের অবসান চেয়েছিল; কিন্তু এতটা চরম অমানবিক মূল্যে নয়।
ফিরে যাই পোকামাকড়ে। গেরিলা যুদ্ধে 'অসম্ভব' বলে কিছু নেই, প্রমাণ করে দুই দশকের টানা যুদ্ধে বীরজাতি ভিয়েতনাম হো চি মিনের নেতৃত্বে। ছারপোকা কোন ছার, চরম ক্ষমতার অধিকারী হয়েও ভিয়েতনাম যুদ্ধে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছিল ইয়াংকিদের।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লীগ-দলের কোনো সিলেবাস নেই। ফলে এখানে পড়াশোনা এবং গবেষণা হয় খুব মনোযোগ সহকারে। এবারের বিষয় পঙ্গপাল নামের পতঙ্গের প্রতিভা। এরা ওড়ে ঘন মেঘের মতো ঝাঁকে, কোটিতে কোটিতে। দিনের আকাশ হয়ে যায় ঘন অন্ধকার। নিচে বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত উজাড় হয়, সবুজ গাছের পাতা সব পঙ্গপালের পেটে। এদের এই নিকটবর্তীতম ঘন ওড়াউড়িতেও বিস্ময়করভাবে ঘটে না পারস্পরিক সংঘর্ষ। এদের মস্তিষ্ক থেকে বিচ্ছুরিত সংকেতে সংঘর্ষ এড়িয়ে যায়। পঙ্গপালের এই বিশেষ প্রতিভার খদ্দের এবার পেন্টাগন না, আমেরিকার গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি জিএম-ফোর্ড প্রভৃতিরা। পঙ্গপালের মতো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো সেন্সর নির্মিতব্য গাড়িগুলোতে স্থাপন করা যায় কি-না এই নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। যাতে করে গাড়িগুলো এড়াতে পারে পারস্পরিক এক্সিডেন্টের সম্ভাবনা। পতঙ্গের প্রতিভা যুদ্ধের পরিবর্তে এবার মানবকল্যাণে। সাধু জিএম-ফোর্ড।
এবার ঢাকার রাস্তায়। নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রায়শই কর্মী দল কর্তৃক সংকুচিত সড়ক। তার ওপর ট্রাক, বাস, সিএনজি, মিশুক, রিকশা, রডভর্তি ঠ্যালা আর সংখ্যায় পঙ্গপালের মতো মানুষ। এমনকি চার বেয়ারিংয়ের চাকার ওপর পঙ্গু ভিক্ষুকও রাস্তার পার্টি। স্বাধীন দেশ। সবার সমান অধিকার। ঢাকার রাস্তায় 'ড্রাইভিং'কে কোনোভাবেই ড্রাইভিং বলা যাবে না। রীতিমতো স্কেটিং। যে যেভাবে পারে কাটিয়ে যায়। নিয়ম-কানুনের থোরাই কেয়ার করে। ঘণ্টায় ষাট মাইল গতির যাত্রীবাহী বাসের সামনে অপরিণামদর্শী পথ পারাপারকারী, দুই হাতে দুই অবোধ শিশু। তিন হাজার সিসি পাজেরোর চাকার পাশে বেয়ারিং ফকির। রিকশার সঙ্গে এক্সিডেন্টে বিপরীত পক্ষ বাদবাকি সব যানবাহন। রাস্তার এই দৈনন্দিনতায় প্রতিদিন এক হাজার এক্সিডেন্ট এবং ফলশ্রুতিতে এক লাখ মানুষের প্রাণ, চার লাখ পঙ্গুত্ব হতে পারত স্বাভাবিক পরিসংখ্যান। কিন্তু তেমনটি হচ্ছে না। হয়ে হয়েও এক্সিডেন্টগুলো হয় না। এর কারণ, একদিকে দেশের অধিকাংশ ড্রাইভারের ব্যক্তিগত দক্ষতা, যা কি-না পঙ্গপালদের সঙ্গে তুলনীয়; অন্যদিকে মরিয়া প্রায় মানুষের প্রাণশক্তি। যে কোনো পরিস্থিতিতে সংগ্রামী মানুষদের বেঁচে থাকার কৌশলগত তীব্রতা।
আমেরিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের কমান্ডো ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তার একটি লাইন সর্বদা সঙ্গ দেয়। 'নিঃশঙ্ক আত্মার চেয়ে বড় কোনো সম্পদ নেই।' তাহের স্যার কোর্স শেষে সনদ পেয়েছিলেন_ ফিট ফর এনি আর্মি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (সেবা প্রকাশনীর 'হেল কমান্ডো' বইটি কৌতূহলী পাঠকদের জন্য)।
একইভাবে আমাদের ঢাকার সড়ক ও জনপথ বিভাগ এখন বাস্তব 'অথরিটি', ঢাকার রাস্তায় ১২ ঘণ্টা এক্সিডেন্ট ছাড়া গাড়ি চালাতে পারলে_ টু হুম ইট মে কনসার্ন_ ফিট ফর এনি রোড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।

No comments

Powered by Blogger.