সপ্তাহের হালচাল-তত্ত্বাবধায়কের ফসল কে ঘরে তুলবে by আব্দুল কাইয়ুম

এক রোববার ২৪ ঘণ্টা আর পরের রবি-সোমবার টানা ৩৬ ঘণ্টার হরতাল শেষে বিএনপি বলছে, দরকার হলে আবারও হরতাল দেবে। কিন্তু তাদের হরতাল কেমন হলো? মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। কারণ, মাঠে নামার মতো মারমুখী কর্মীর অভাব ছিল। এ রকম হতে পারে ভেবে বিএনপির চেয়ারপারসন আগেই মহানগর কমিটির নেতৃত্বের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ

করেছেন। নেতা-কর্মীরা মাঠে নামেন না, সে খবর যে তিনি রাখেন এবং মপর পরিণতি সম্পর্কে তিনি হুঁশিয়ার করে দেন। গত সোমবার দৈনিক ইত্তেফাক কোথায় কোথায় হরতাল হয়নি, তার বিস্তৃত এক ফর্দ দিয়েছে। আবার অনেক উপজেলায় ইউপি নির্বাচন আনন্দঘন পরিবেশে হয়েছে বলে খবরও বেরিয়েছে। ওই সব এলাকায় হরতাল স্থগিত রাখা হয়নি। অর্থাৎ হরতালের মধ্যেই সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলেছে।
এসব ব্যাপারে বিএনপির মাথাব্যথা নেই। হরতাল ডেকেই খালাস। সুযোগ বুঝে সরকারও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে যাকে-তাকে ধরে জেল দিচ্ছে। অনেক নিরীহ লোক হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকার একটা খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করল। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দমনে বাড়াবাড়ির পরিণাম ভালো হয় না। সরকার হয়তো ভাবছে, কঠোর হাতে সবকিছু ঠান্ডা করে দেবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, যারা ওই পথে গেছে, তাদের শেষ পর্যন্ত আফসোস করতে হয়েছে।
কিন্তু কী নিয়ে হরতাল আর কী কারণে সরকার এত খেপে উঠেছে, তা বোঝা মুশকিল। সমস্যার শুরু হয়েছে যখন সরকার বলল, তারা উচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে যাবে না, তাই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হবে। কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণে তো আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত না রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতের রায় মানার কথাই যদি ওঠে, তাহলে দুটি বিষয় একসঙ্গে আসার কথা। কিন্তু সরকার বিষয় দুটিকে বিযুক্ত করে আদালতের রায় প্রকৃতপক্ষে বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন করেছে। এখানেই গণ্ডগোলের মূল।
সরকার দুটি বিষয় ভাগ করে ফেলেছে। প্রথমে এক নিঃশ্বাসে বলছে, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে না। এর পরের নিঃশ্বাসে বলেছে, বিএনপি যদি পর্যবেক্ষণের উল্লিখিত ওই দুই মেয়াদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, তাহলে সংসদে এসে তাদের প্রস্তাব দিতে হবে। যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য মাথাব্যথা একমাত্র বিএনপির। কেন? আওয়ামী লীগ কি ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে এই তত্ত্বাবধায়কের জন্য মাথা কুটে মরেনি? তখন যেটা ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান, এখন সেটাই চক্ষুশূল হয়ে গেল?
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া কোনো কিছু মানবে না। এমনকি আদালতের রায় মানা বাধ্যতামূলক নয় বলে তারা বলছে। এটা কী করে হয়? তারা সংসদেও যাবে না, আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারেও ‘কিন্তু’ আছে। সেই কিন্তুটা হলো, অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান উপদেষ্টা মানবে না। কারণ, তিনি নাকি আওয়ামী ঘেঁষা। এ যে সেই ‘চুল ভেজাব না’ বলে জেদ ধরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার নদীতে অবগাহন করব, কিন্তু চুল ভেজাব না! এটা কী করে হয়? হয় মানেন, না হয় মানবেন না। এটাও চাই, ওটাও চাই? বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কি আওয়ামী লীগের দুই টাকার টিকিটধারী সদস্য ছিলেন, নাকি কোনো কমিটির নেতা ছিলেন—যেমন ছিলেন বিচারপতি কে এম হাসান? যদি সে রকম হয়, স্পষ্ট করে বলুন, না হলে ভেজাল বাড়িয়ে লাভ কী?
মনে হয়, একটা দরাদরি চলছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার ফসল কে কত বেশি নিজের ঘরে তুলতে পারবে, সে জন্যই এক পক্ষের এত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও; আর অন্য পক্ষে হরতাল দমনের নামে ধরপাকড় চলছে। ৫ জুন হরতালের পর বিএনপি মহলে এমন একটা ভাব আসে, যেন তাদের বিজয় আসন্ন। কারণ, আওয়ামী লীগকে অন্তত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মেনে নিতেই হবে। তখনই তারা ‘বিজয় হয়েছে’ বলে মাঠে নেমে পড়বে। আর যদি সরকার সেদিকে না যায়, তাহলে আন্দোলন চলতেই থাকবে। এর সুফল তারা পাবেই। অন্যদিকে সরকারপক্ষ ভাবছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য সংসদে না এসে বিএনপির উপায় নেই। তখন আওয়ামী লীগ বলতে পারবে, যারা একদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে জিহাদে নেমেছিল, তারাই আজ সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য জোরহাত করছে!
মনে হয়, কারও আশাই (দুরাশা?) পূর্ণ হবে না। কারণ, যদিও নির্বাচনের প্রায় আড়াই বছর বাকি, তা-ও দুই পক্ষ এখন থেকেই নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে। তাই কেউ কারও কাছে হার মানতে চাইবে না। কিন্তু যখন অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বললাম, তিনি বললেন, ‘দলের অবস্থান ঠিক বলতে পারি না। তবে মনে হয়, আওয়ামী লীগ যদি স্পষ্ট করে বলে যে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে তারা আলোচনা করতে রাজি, তাহলে বিএনপির আলোচনায় না যাওয়ার কোনো কারণ নেই।’ সাংবাদিক আতাউস সামাদ লিখেছেন, ‘বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, সরকার যদি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দ্বিতীয় অংশ মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়, তাহলেও বিএনপি এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য সংসদে যাবে (আমার দেশ, ১৩ জুন, ২০১১)।’ ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কতটা এগিয়ে আসবে? তারা কি সে রকম কিছু আহ্বান জানাবে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রস্তাব থাকলে তা জাতীয় সংসদে এসে উত্থাপনের জন্য বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ মহলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনায় জানা গেছে, তাঁরাও মনে করেন, দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু আগ্রহটা দেখাতে হবে বিএনপিকেই!
এখন কীভাবে এই অচলাবস্থার মীমাংসা হবে, তা কেবল ভবিষ্যৎই বলতে পারে। আবার কোনো এক-এগারো আসে কি না, এ রকম আশঙ্কার কথাও আলোচিত হচ্ছে। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ তাঁর ইনটুইশন (অন্তর্জ্ঞান) থেকে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের পর এই সরকার আর না-ও থাকতে পারে।’ তাহলে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখি, কী হয়! কিন্তু এর এক দিন আগে ডিকাবের মতবিনিময় সভায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এক-এগারোর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করেন কি না—এ রকম এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে, জনগণের প্রতিনিধিদের দেশ চালাতে দিতে হবে।’ এই দুজন বেশ ওজনদার লোক। কিন্তু তাঁদের কথা পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রয়োজনে টানা সাত দিন হরতালের কর্মসূচি দেওয়ার কথা বলেছেন। এতে কোনো লাভ হবে না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অনেক চেষ্টা করেছে। সরকার পড়েনি। ১৪৭ জন সাংসদ একযোগে পদত্যাগ করার পরও এক বছর পর্যন্ত বিএনপি সরকার ধুঁকে ধুঁকে চালিয়ে গেছে। এবার বিএনপি টানা সাত থেকে ১০ দিন হরতাল করেও মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের অদূরে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক ডামাডোলের উদাহরণ নেওয়া যায়। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং ২০০৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত থাকসিন সিনাওয়াত্রা দুবাইয়ে বসে কলকাঠি নাড়ছেন। তিনি আগাম নির্বাচনের জন্য অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় করে দেশে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। মাসের পর মাস ব্যাংককের মূল একটি রাজপথ অবরোধ করে রেখেছিলেন, কিন্তু আগাম নির্বাচন আদায় করা যায়নি। অবশেষে আগামী ৩ জুলাই নির্বাচনের তারিখ পাওয়া গেছে। এর ফল সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। তবে সবাই মনে করে, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকটের অবসান হবে না।
বাংলাদেশের অবস্থা থাইল্যান্ডের মতো না হলেও একটা বিষয়ে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। সেটা হলো, রাজনৈতিক সমঝোতা। এর বিকল্প নেই। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের একটি ব্যবস্থার ব্যাপারে ঐকমত্যই হতে পারে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তি।
আমরা কামনা করি, এ ব্যাপারে দুই দলের যেন সুমতি হয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.