ধর্ম-শিশুশ্রম নিরসনে গণসচেতনতা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। অথচ সমাজজীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে অল্পবয়স্ক শিশুদের কাজ করতে দেখা যাবে না। হতদরিদ্র পিতা-মাতা সংসারে শিশুরা অর্থ উপার্জনে অগ্রসর হয়। সরকার শিশু অধিকার রক্ষা ও শিশুশ্রম নিরসনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করেই শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই যতটা সম্ভব শিশুর কর্মস্থল ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করা প্রয়োজন। ইসলামের শ্রমনীতিমালা অনুসারে কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব প্রদান করা সমীচীন নয়। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কারও ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬)
অথচ দেশে এক কোটি শিশু কায়িক শ্রমে নিয়োজিত। দারিদ্র্যের কারণে দেশের হাজার হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। শিশু নির্যাতনও বাড়ছে। শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, যেমন—উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের প্রতিটি কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সামগ্রিকভাবে শিশুদের নিপীড়নমূলক এসব কাজ থেকে মুক্তি দিতে ধর্মীয় সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তাদের সামর্থ্যের অধিক কাজ করাতে চাইলে তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করো এবং তাদের ওপর শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দিয়ো না।’ (বুখারি)
আজ যারা শিশু, আগামী দিনে তারাই যুবক। শিশুরাই সুশোভিত ও গৌরবময় আগামীর পথনির্দেশক। উন্নত ও ধনী দেশে শিশুরা সব ধরনের অধিকার পেলেও দরিদ্র দেশগুলোতে তারা অধিকারবঞ্চিত থেকে যায়। শিশুশ্রমিক যেমন শহরে আছে, তেমনি গ্রামেও আছে। দেশে বিপুলসংখ্যক শিশুশ্রমে নিযুক্ত থাকায় একদিকে যেমন তারা সুন্দর ও নিরাপদ শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। আজকের শিশুদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বা শিশুরা পার্থিব জীবনের শোভা।’ (সূরা আল-কাহ্ফ, আয়াত: ৪৬)
দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোতে শিশুশ্রম চালু হওয়ার প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত পেটের তাগিদে, অন্যদিকে শিশুশ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। এ জন্য নিয়োগকারীরা শিশুদের বিভিন্ন কাজে লাগায়। শিশুশ্রমিকেরা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে, যার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমাও নেই। তাদের বেশির ভাগই ১২-১৫ ঘণ্টা কাজ করে। বিশ্রাম বা বিনোদনেরও কোনো অবকাশ নেই। কাজেই একেবারে বিশ্রামহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে শিশুদের বাধ্য করা যাবে না। একসঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পর অনুরূপ নিরবচ্ছিন্নভাবে কিছুক্ষণ তাকে অবসর তথা আরাম-আয়েশ ও বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় অবকাশ দিতে হবে—এটিও শিশুর মৌলিক মানবাধিকারের পর্যায়ে গণ্য।
ইসলামের নৈতিক শিক্ষা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ধর্মীয় পরিবেশ না পেলে শিশুর যথার্থ বিকাশ সাধিত হয় না। নবী করিম (সা.) অবহেলিত শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্মে-কর্মে যথার্থ মানুষ হিসেবে গঠন করেছিলেন। তিনি শিশুদের ভালোবাসতেন। যেকোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। শিশুদের প্রতি কোমল ব্যবহার নিজে করেছেন এবং অন্যদের সদাচার করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শিশুদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিযি)
সমাজজীবনে বাস্তবতার নিরিখে শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও কম ঝুঁকিমুক্ত পেশায় নিয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি পড়াশোনার সুযোগও রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো শিশুশ্রম প্রতিরোধমূলক কাজে এগিয়ে আসতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞান দান করো, কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (মুসলিম)
যে হাতে বই-খাতা-কলম থাকার কথা, সে হাতে তারা হাতুড়ি তুলে নিচ্ছে, ইট ভাঙছে, শ্রমিক হয়ে কাজ করছে। গরিবের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর দ্বারে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। কত অসহায় এতিম শিশু দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে, নির্যাতিত হয়ে বাঁচার অধিকার হারাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এভাবেই শিশু পাচার করে উটের জকি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। নিষ্পাপ শিশুকে জোর করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করিয়ে জীবনে এক ভীতিকর পরিবেশে ঠেলে দেওয়া হয়। এসব অসহায় শিশুর জন্য মুসলিম বিশ্বকে ভালোবাসার হাত বাড়াতে হবে। আজকের প্রজন্মের শিশুরাই ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাই নতুন প্রজন্মের হাতগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে তথা শিশুদের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিক্ষার সুযোগ বিস্তৃত করা ছাড়া শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। সমাজে শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে সুশিক্ষার পথ প্রশস্ত করে দিলে উন্নত জনবল মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের শক্তি হিসেবে গণ্য হবে। প্রতিটি দেশের সরকার ও সমাজের ধর্মপ্রাণ-বিত্তবান লোকদের এসব শিশুর জন্য মানবতার সেবার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। শিশুদের জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সঙ্গে চারিত্রিক গুণাবলিও অর্জন করতে হবে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। প্রত্যেক শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সব অভিভাবকের দায়িত্ব।্রতাই ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনকল্পে বিশ্বের প্রতিটি মানবশিশু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মৌলিক মানবাধিকার পেয়ে নৈতিক মূল্যবোধ, আদর্শ ও মহৎ গুণে বড় হোক, এটাই বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.