গন্তব্য ঢাকা-হাহাকার শুধু গ্রামে ফেরার জন্য by শর্মিলা সিনড্রেলা

মনুষ্যত্বের অনেক দাম মানুষের জীবনে। মনুষ্যত্ব না থাকলে জীবনটা যেন ঠিক উপভোগ করা যায় না। রংচঙে এই ঢাকা শহরে মনুষ্যত্বেরই বড় অভাব। কেউ যদি চরম দুরবস্থায় পড়ে, তখন আমরা যেমন তার পাশে দাঁড়াই না; তেমনি যদি দেখি চোখের সামনেই ঘটে চলেছে কোনো অন্যায়, তবু অনেক সময় প্রতিবাদ করি না।

কিন্তু গ্রামে একজন আরেকজনের কেবল প্রতিবেশী বা পরিচিতই নয়, প্রত্যেকে প্রত্যেকের বন্ধুও বটে। তাই যেকোনো একজনের সামান্য বিপদে সবাই একসঙ্গে এসে বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত।’ যখন বিপদে পড়েন তখন তো বটেই, বাকি সময়ের অধিকাংশটাই আতিকুর রহমানের কাটে এভাবে গ্রামের কথা ভেবে। দিনের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সকালে মন-মেজাজ অনেক ভালো থাকে। তখন যদিও ঢাকা শহরটাকে একটু ভালো লাগে, একটু একটু করে সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যায় মানসিক অবস্থা। মেজাজ ওঠে চরমে। সবকিছু ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কোথায় আবার? সেই প্রিয় সোনারগাঁয়ে|’
একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা আতিকদের। বেশ আনন্দে-আয়োজনে দিন গুজরান হতো তাঁদের। ভাইবোনেরা মিলে দিনরাত খুনসুটি। চলছে তো চলছেই, অবিরাম। আতিকেরা পাঁচ ভাই। ভাইয়েরা যেন ঠিক ভাই না, বন্ধু। তাই আনন্দ সীমাহীন। কোনো এক মজার ঘটনা বলতে চাইছিলেন আতিক, ভাইদের নিয়ে। বলার আগেই তিনি হেসে কুটি কুটি। কোনো রকমে হেসে হেসে যা বলেন তা হলো এমন, ‘আমাদের অনেক সুপারিগাছ ছিল। এখনো অবশ্য আছে সেসব।
তখন সবে বড় হয়ে উঠছি। একটু-আধটু হাতখরচের টাকা তো লাগেই। বাবার কাছে আর কত চাইব? তাই একদিন ভাবলাম, বাড়িরই তো সুপারি। যাই কিছু বিক্রি করে দিই, তাহলে হাতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। অবশ্য বাড়ির কাউকে জানাতে চাইনি। কেননা, জানালে আর বিক্রি করতে দেবে না। গ্রামে সন্ধ্যার পরেই চারপাশ একদম চুপচাপ হয়ে যায়। তাই সন্ধ্যার পরেই গেছি গাছ থেকে সুপারি পাড়তে। ভাবছিলাম, পরদিন সবার অগোচরে ওগুলো বিক্রি করে দেব। অন্ধকার রাতে সুপারিগাছে অর্ধেকটা উঠেছি। হঠাৎ মনে হলো গাছের ওপরে কোনো শব্দ হলো। অন্ধকারটা যখন চোখ সওয়া হয়ে গেল, তখন দেখলাম ওপরে আরেকজন কেউ সুপারি চুরি করছে। চিৎকার শুরু করলাম আমি। ‘কে ওখানে? কে ওখানে?’ নেমে আসার পর দেখি আমারই ছোট ভাই আবু হানিফ। সে ওই গাছের মগডালে উঠেছিল সুপারি চুরির উদ্দেশ্যে।’ কথাগুলো শেষ করেই হেসে ওঠেন আতিক। সঙ্গে সঙ্গে হেসে ওঠেন পাশে বসে থাকা আবু হানিফও। দমকে দমকে হেসে আবার বলেন আতিক, ‘সবাই জেনে যাবে দেখে আমি তো ভয়ে কাঠ। তবে যেহেতু আমি বড়, তাই ছোট ভাইকে বকা দিয়ে বাঁচতে চাইলাম। অবশেষে অবশ্য কাউকেই শাস্তি পেতে হয়নি। বাবা-মা কিছুই বলেননি।’ গ্রামের ওসব দিনের কথা মনে করে আরও বেশি গ্রামের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন আতিকুর রহমান।
ঢাকা শহরের সঙ্গে আতিকুর রহমানের সম্পর্ক মাত্র এক বছরের। গ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে অনার্সটা বেশ ভালোভাবেই শেষ করলেন গত বছর। বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করে তিনি পেয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণী। এখন মাস্টার্স করার ইচ্ছে তাঁর। ইচ্ছে আছে ভালো কোনো চাকরি করার। কিন্তু ভাগ্যদেবতা কবে প্রসন্ন হবেন কে জানে! তাই বসে পড়েছেন সিল তৈরির কাজে। পুরানা পল্টন মোড়ে ইসলামী ব্যাংকের নিচে বসে তিনি তৈরি করেন সিল। রাবার, প্লাস্টিকের ব্যাট, কাঁচি নিয়ে এখানে সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সময় কাটান তিনি। যা আয় হয় তাতেই খুশি তিনি। কিন্তু এখানে অন্যের কষ্ট দেখলেই বাড়ে কষ্টটা। মনে হয় গ্রামে সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ হলেও না খেয়ে কেউ থাকে না। কারও বাড়ির একমুঠো চাল আর আশপাশে জন্মে থাকা শাক দিয়েই একটু ভাত মুখে দিতে পারে। কিন্তু এখানে কত মানুষ না খেয়ে দিন পার করে, তার সীমা নেই।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে চর আবাবিল নামের গ্রামটি আতিকুর রহমানদের। গ্রামের পাশে কিছু দূরে রয়েছে নদী আর বাড়ির লাগোয়া রয়েছে নিজেদের পুকুর। নদী যদিও টানত বেশি, উপভোগ বেশি করা হতো সেই ছোট্ট পুকুরটাকেই। সকাল-দুপুর দাপাদাপি। পাঁচ ভাইয়ের সবাই থাকেন এই ঢাকাতেই। গ্রামে থাকেন কেবল মা কুলছুমা বেগম আর বাবা মোস্তফা তালুকদার। গ্রামে গেলেই মনটা আরও হাহাকার করে ওঠে আতিকুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘হিংসে হয় খুব মা-বাবাকে দেখে। ওরা কত ভালো আছে গ্রামের শীতল ছায়ায়। আর আমি এখানে বিরক্তিকর জীবন যাপন করছি।’ কড়া রোদ, ব্যস্ত রাস্তা আর অগুনতি মানুষ দেখতে দেখতে আতিকুর রহমান গ্রামে ফেরার স্বপ্ন দেখেন। ভাবেন, ‘যদি ভালো কোনো কাজের সুযোগ পাই গ্রামের দিকে, তবে সব ফেলে ছুটে যাব সেখানেই।’
শর্মিলা সিনড্রেলা

No comments

Powered by Blogger.