শুদ্ধ তালিকা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করুন-জাল মুক্তিযোদ্ধা, আসল সুবিধা

হাজার হাজার জাল মুক্তিযোদ্ধার খবরটি উদ্বেগজনক। সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই কার্যত মুক্তিযোদ্ধা নন। এই জাল সনদধারীরা কেবল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেই প্রতারণা করেন না, বঞ্চিত করেন আরেকজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে, প্রতারণা করেন সরকারের সঙ্গে।

কিন্তু সরকারের সঙ্গে জড়িত লোকজনই যখন এই প্রতারণাকে জায়েজ করেন, তখন চিন্তিত হয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিতে ভুয়া সনদের কেরামতি তেমনই এক চিন্তার বিষয়।
প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কোটা বরাদ্দ করা রয়েছে। গর্হিত উপায়ে এর সুবিধা নেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদনকারীদের এক হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৫২ জনের সনদই ভুয়া। মুক্তিযোদ্ধা বলে চাকরির বয়স বাড়ানোর আবেদনকারীদের মধ্যে ২৫ জনের কাগজপত্র সন্দেহজনক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, যাঁদের হাতে রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার। রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেওয়া সাত হাজার সনদধারীকে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভুয়া সনদের জোরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেড় হাজার চাকরি বেহাতে গেছে বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম না থাকলেও, দিব্যি তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। এই ভুয়া সনদধারীরা মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে কলঙ্কিত করছেন, বঞ্চিত করছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের—এসব চাকরির দাবিদার তো তাঁরাই।
সনদ জালিয়াতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সই জাল করেই তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। মন্ত্রী-সাংসদদের সুপারিশ আদায় তদবির-বাণিজ্যেরই অংশ। একে ঘিরে স্থানীয় নেতা-টাউটদের নিয়ে একটি চক্রও দাঁড়িয়ে গেছে। এ বিষয়ে প্রথম আলোর বুধবারের প্রতিবেদনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাতে বলা হয়েছে, তাঁরা মন্ত্রী-সাংসদদের সুপারিশের বাইরে যেতে পারেন না। পেশাগত দৃঢ়তার অভাব এবং দলীয় আনুগত্য প্রবল হলে এমনটা হতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পুরো বিষয় যাচাই-বাছাই করে অনিয়মের কার্যকারণ চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুফল পেতে হলে তাঁকে মন্ত্রী-এমপি তথা রাজনৈতিক চাপ থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় চাপ ঠেকানো না গেলে, সকলই গরল ভেল হতে বাধ্য।
দেখা যায়, যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলই দলীয় বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নতুন করে প্রণয়ন করে। এত সব বিশৃঙ্খলার মধ্যেই সুযোগ থাকে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের সারিতে নকলদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার। দলনিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শুদ্ধ তালিকা প্রণয়ন সে জন্যই দরকার। এর বাইরে কারও সুপারিশ এলে তাঁকে সন্দেহ করে অনুসন্ধান চালাতে হবে। যাঁরা সুপারিশ করেছেন এবং অবৈধভাবে চাকরি বা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে তাঁদেরও। যেখানেই প্রক্রিয়াগত ফাঁকি, সেখানেই দুর্নীতির সুযোগ। তাই প্রক্রিয়া যথাযথ করুন, অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করুন এবং প্রশাসন ও মন্ত্রী-সাংসদদের কার্যবিধি ঠিক করে দিন। সেটাই হবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনার উপযুক্ত প্রতিকার।

No comments

Powered by Blogger.