পদ্মা সেতু নিয়ে উভয় সংকট by আনোয়ার হোসেন

পদ্মা সেতু নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে সরকার। মালয়েশিয়ার অর্থায়নে সেতু করতে হলে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করতে হবে। তাতে সম্পর্কের আরও বেশি টানাপোড়েন তৈরি হবে। আবার মালয়েশিয়া সেতু তৈরি করে দিলে এর সেবার ব্যয় হবে অত্যধিক বেশি। অন্যদিকে দাতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে দুর্নীতির অভিযোগও মানতে হবে।


সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু নিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এতে পদ্মা সেতু নিয়ে অনিশ্চয়তাও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা দুর্নীতির অভিযোগে সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছে। এ পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু তৈরিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সেতু তৈরি নিয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সইয়ের সম্ভাব্য তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে সেতু বিভাগ সূত্র এখন বলছে, ২১ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা সই (এমওইউ) না-ও হতে পারে। মূলত নানা জটিলতার কারণেই এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় সেতু তৈরির কথা ভাবছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছে। অন্যদিকে দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি)। সূত্র জানায়, দাতারা একটি চুক্তি থাকতে একই বিষয়ে নতুন করে চুক্তি করার আইনি ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এর সদুত্তর এখনো দিতে পারেনি, আবার মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন চুক্তির কথাও আনুষ্ঠানিকভাবে দাতাদের জানায়নি সরকার। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার সঙ্গে এমওইউ ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা এর আগে-পরে হতে পারে। তবে আমি পদ্মা সেতু চাই। এক বছরের মধ্যে কাজ শুরু করব।’ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে করা চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও অর্থ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে অর্থায়ন, কত বছরে সে টাকা উঠিয়ে নেওয়া হবে, সেটা পরে ঠিক করা হবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে গত বুধবার সেতু বিভাগে মালয়েশিয়ার অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা করতে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভাসূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিল না করে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা যাবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে করা চুক্তির খুঁটিনাটি বিচার করে ঠিক করার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সেতু বিভাগের সচিব, ইআরডি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ইআরডি জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল না করে নতুন কারও সঙ্গে এমওইউ বা চুক্তি করা যাবে না।
মালয়েশিয়ার প্রস্তাব: সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, গত ১৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়া সরকারের বিশেষ দূত এইচ ই দাতো সেরি এস সামি ভেলি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে আগ্রহ দেখান। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশিয়ার অর্থ নিতে সম্মতি জানালে পিপিপির আওতায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়।
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে। বাকিটা বাংলাদেশ সরকার দেবে। মালয়েশিয়া দুবাই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ বা বাজারে বন্ড ছেড়ে সংগ্রহ করবে বলে জানিয়েছে সরকারকে। বিনিয়োগ করা অর্থ ৩৫ বছরে উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মালয়েশিয়া। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে সরকারনিয়ন্ত্রিত ইউনাইটেড ইঞ্জিনিয়ার্স মালয়েশিয়া (ইউইএম)। আরও বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে (কনসোর্টিয়াম) সেতু নির্মাণ করবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়।
সেতু বিভাগেরই আরেক প্রকল্প উড়ালসড়ক পিপিপিতে করা হচ্ছে। থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাইল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি এভাবে ঋণ নিয়ে উড়ালসড়ক করার জন্য চুক্তি করে গত এপ্রিল মাসে। কিন্তু এখনো তারা অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। কারণ, টাকায় টোল আদায় করে ডলারে তা পরিশোধের বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আস্থায় নিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ৫ শতাংশের ওপর সুদ দিতে হবে। চড়া সুদে অর্থ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলে টোলও বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা দেওয়ার চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের হার দশমিক ৭৫ শতাংশ। ৪০ বছরে ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর কোনো ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।
এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি করেছিল। এ তিন সংস্থার ঋণের সুদের হার বিশ্বব্যাংকের মতোই কম।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে যে কথাবার্তা হচ্ছে, সেটা হলে নির্মাণব্যয় বাড়বে এবং এতে টোল হারও বেড়ে যাবে। কত বাড়বে, তা চুক্তির আগে বলা যাবে না। সম্ভাব্য সব বিকল্পের মধ্যে বিশ্বব্যাংক থেকেই সবচেয়ে সস্তায় ঋণ পাওয়া যাবে—এটা জেনেই সরকার তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে চুক্তি থাকায় অন্যের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া যাবে না। সরকারকে চুক্তি বাতিল করতে হবে, নতুবা দাতারা চুক্তি বাতিল করবে। তারপর নতুন চুক্তি হবে। তবে সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত চুক্তি নয়। তাই চূড়ান্ত চুক্তির আগেই সরকার বিষয়টি ফয়সালা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দাতাদের সঙ্গে সম্পর্ক: গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে। এরপর যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেয় সরকার। বিশ্বব্যাংককে অর্থায়নে রাজি করাতে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটনে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করলে খানিকটা অগ্রগতিও হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়, এর পরই পদ্মা সেতুতে ঋণ কার্যকরের সময়সীমা ছয় মাস বৃদ্ধি করে বিশ্বব্যাংক। সেতু বিভাগ তিন মাস বৃদ্ধির জন্য চিঠি দিয়েছিল, কিন্তু বিশ্বব্যাংক বৃদ্ধি করে ছয় মাস। ছয় মাস বৃদ্ধির পেছনে প্রধানমন্ত্রীর ওই উপদেষ্টার ভূমিকা রয়েছে। কারণ, বিশ্বব্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের মেয়াদ অবস্থায় অর্থছাড়ে জটিলতা হতে পারে, সে আশঙ্কায় ছয় মাস বৃদ্ধি করা হয়।
তবে এডিবি ও জাইকা ঋণ কার্যকরের সময়সীমা তিন মাস বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২৭ জানুয়ারি ছিল ঋণ কার্যকরের শেষ দিন। জাইকা ২৬ জানুয়ারি এবং এডিবি ও বিশ্বব্যাংক ২৭ জানুয়ারি ঋণ কার্যকরের সময়সীমা বৃদ্ধির কথা জানায়।
ঠিক এ সময়ে দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে বিদেশিদের অর্থ নেওয়া হবে না—প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য এবং বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের না জানিয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিকল্প অর্থায়নের উদ্যোগ ভালোভাবে নেয়নি দাতারা। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিদ্যুৎ, স্থানীয় সরকার উন্নয়নসহ বর্তমানে ৩৪টি চলমান প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করছে। এর জন্য দেওয়া হচ্ছে ৫৯০ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জটিলতা অন্য প্রকল্পগুলোতেও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
মালয়েশিয়ার প্রস্তাব ও পরবর্তী কার্যক্রম: মালয়েশিয়ার দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কয়েকটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠান যৌথভাবে নির্মাণ পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওটি) পদ্ধতিতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রস্তাব অনুযায়ী, দুই পক্ষ একমত হলে ইউইএম এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খোলা দরপত্রের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে সেটা করা হবে না। খোলা দরপত্র-প্রক্রিয়া এড়ানোর জন্য মালয়েশীয় সরকারকে এ প্রকল্পে সম্পৃক্ত করছে সরকার। তাই সমঝোতা স্মারক সই হবে দুই সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে।
সেতু বিভাগের প্রস্তুতি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজি হওয়ার পর সেতু বিভাগ মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে সমঝোতা স্মারকের খসড়া পাঠানো হবে। খসড়া পেলেই তারা তাদের মতামত দিয়ে চূড়ান্ত করবে। সমঝোতায় মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ কে কত অর্থ দেবে, সেটা উল্লেখ থাকবে। কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হবে, টোল কত নির্ধারণ করা হবে, কত বছর পর সেতুটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে, মালয়েশিয়া কোন উৎস থেকে অর্থ জোগান দেবে, সে বিষয়গুলো থাকবে চূড়ান্ত চুক্তিতে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আসলে পদ্মা সেতু করার মতো প্রযুক্তিগত যোগ্যতা মালয়েশিয়ার নেই। তারা চীন থেকে ঠিকাদার নিয়োগ করবে হয়তো। মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় পেনাং সেতু চীনের অর্থায়নে চীনা ঠিকাদারেরা করছেন। পদ্মা সেতুর জন্য দুবাই থেকে অর্থ সংগ্রহের কথা শোনা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মালয়েশীয় সরকারের ভূমিকা কী হবে, তা পরিষ্কার নয়। আর পিপিপিতে করতে হলে বিনিয়োগকারী যে ঋণ করবে, তার সুদ ৫ থেকে ৬ শতাংশ হবে। সে ক্ষেত্রে টোল বেড়ে যাবে এবং সেটা ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ বছরে তুলতে পারবে কি না, সে সন্দেহ থেকেই যায়।

No comments

Powered by Blogger.