রঙ্গব্যঙ্গ-ভূরিভোজ by মোস্তফা কামাল

আবদুর রশিদ খুবই ভোজনবিলাসী মানুষ। খেতে খুব পছন্দ করেন। খাবার দেখলে আর সহ্য করতে পারেন না। পেটে ক্ষুধা না থাকলেও খাবার দেখলেই তাঁর ক্ষুধা বেড়ে যায়। তিনি ভরা পেটেও বেশ খেতে পারেন। কারো খাবারের অফার তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, এমন নজির নেই। খাবার নিয়ে তিনি খুব একটা বাছবিচারও করেন না।


খাবার হলেই হলো, তিনি গোগ্রাসে গিলতে থাকেন। বিরিয়ানি-খিচুড়ি হলে তো কথাই নেই। জীবনে তিনি কোনো দাওয়াতই মিস করেননি। বিয়ে, কাঙালিভোজ কিংবা কুলখানি_সব দাওয়াতই তিনি ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেন আর আনন্দের সঙ্গে তাতে অংশ নেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন পার্টি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে বিনা দাওয়াতেই তিনি উপস্থিত হয়ে গেছেন। উপহার-উপঢৌকন কিনতে কিছু খরচ হলেও তিনি দাওয়াত মিস করতে রাজি নন। এমন কোনো দিন নেই যে তিনি ভূরিভোজ করেননি। তাঁর এক কথা, 'খেয়েদেয়ে কামাই, ঝি বাঁচলে জামাই।' অর্থাৎ খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকার জন্যই নাকি মানুষ এত কষ্ট করে। যদি না-ই খেলাম, তাহলে এত কষ্ট করে লাভ কী! তাই তাঁর কি রিচ ফুড, কি পুওর ফুড_কোনো কিছুতেই না নেই।
আবদুর রশিদের খাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের নান্দনিকতা আছে। অনেকে তাঁর খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করে। ভীষণ মজা করে, সন্তুষ্ট চিত্তে তিনি খেতে থাকেন। অনেকে তাঁকে আবদুর রশিদের পরিবর্তে ভোজনরসিক বলে ডাকেন। তাতেও তিনি আপত্তি করেন না।
আবদুর রশিদকে একবার গণ-অনশনে দাওয়াত দেওয়া হলো। জীবনে কোনো দাওয়াতই যেহেতু মিস করেননি, এই দাওয়াত মিস করবেন কেন! তা ছাড়া এলাকার গণমান্য লোক বশির উদ্দিন। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁকে তো আর অসম্মান করা যায় না! তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন আবদুর রশিদ। কিন্তু গণ-অনশনের অর্থ তিনি বোঝেন না। এ নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শিক্ষিত মানুষ! এই শব্দের অর্থ কী তাও তিনি জিজ্ঞাসা করতে পারছেন না। অর্থ না জানা পর্যন্ত তাঁর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমছে না। দুশ্চিন্তায় তিনি কেমন যেন হয়ে যান। আবদুর রশিদের অবস্থা দেখে তাঁর স্ত্রী জানতে চান, ব্যাপার কী বলো তো? তুমি কোনো সমস্যায় আছ নাকি?
আবদুর রশিদ বললেন, হুম! মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছি!
কী রকম?
আমাকে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানের নাম হচ্ছে গণ-অনশন। কিন্তু এই গণ-অনশনের অর্থ আমি বুঝি না। তাই দুশ্চিন্তা করছি।
বলো কী! এর অর্থ তো সোজা!
তাই! তাহলে বলো।
অনশন মানে হচ্ছে উপোস থাকা; মানে না খেয়ে থাকা। আর গণ-অনশন মানে জনগণের না খেয়ে থাকা। গণ মানে জনগণ। মানে অনেক মানুষ।
ধ্যাৎ! তুমি পাগলের মতো এসব কী বলছ?
হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। তুমি ডিকশনারি দেখতে চাও?
না, আবার ওসব দেখার দরকার নেই।
তাহলে তুমিই বলো, তুমি কী বুঝছ?
আচ্ছা, সবাই জানে আমি ভোজনরসিক মানুষ। জানে না?
হ্যাঁ, জানে।
তাহলে জেনেশুনে আমাকে গণ-অনশনে দাওয়াত দেবে কেন? আমাকে দাওয়াত দেবে ভূরিভোজ অনুষ্ঠানে।
সারা জীবন তো ভুরিভোজ করলে। এবার একটু অনশন করো।
এসব তুমি কী বলছ? না, না। না খেয়ে আমি থাকতে পারব না। তাহলে ওসব অনশন-ফনশন বাদ। আমার যাওয়ারই দরকার নেই।
সেটা তোমার ব্যাপার। আর একান্তই যদি যেতে না চাও তাহলে যিনি দাওয়াত দিয়েছেন তাঁকে বলো। আমাকে বলে কী হবে?
আবদুর রশিদ গেলেন বশির উদ্দিনের কাছে। কিন্তু কথাটা তাঁকে কী করে বলেন! তিনি কথাটা বলবেন বলবেন করছিলেন, কিন্তু বলতে পারছিলেন না। তাঁর ভাবসাব দেখে বশির উদ্দিন নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, রশিদ সাহেব, আপনি কিছু বলবেন?
জি।
কী বলবেন বলুন তো?
না, মানে...আপনি যে দাওয়াত দিলেন সেটা কিসের অনুষ্ঠান যেন?
গণ-অনশন।
এটা আবার কী?
এটা একটা অনুষ্ঠান।
কিসের অনুষ্ঠান? এর মানে কী?
ওহ! আপনি জানেন না!
জি না।
এটা হলো ভূরিভোজের অনুষ্ঠান।
তাই নাকি! আমার বউ যে বলল এটা না খেয়ে থাকার অনুষ্ঠান!
আরে ভাই, আমি জেনেশুনে আপনাকে কষ্ট দেব? আমি তো জানি, আপনি খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠান ছাড়া যান না। না খাওয়ার অনুষ্ঠানে আপনাকে দাওয়াত দেব কেন?
তাই বলেন! আচ্ছা ভাই, আমার বউ কি তাহলে মিথ্যা বলল?
হুম! আপনার ভূরিভোজ আপনার স্ত্রীর সহ্য হচ্ছে না, বুঝলেন! আর অনশন না ভূরিভোজের অনুষ্ঠান, সেটা তো গেলেই দেখবেন!
তা তো দেখবই। কিন্তু যাওয়ার পরে যদি...
আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না তো! আমি আপনার সঙ্গে আছি না!
আবদুর রশিদ অবশেষে গণ-অনশন অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। অনুষ্ঠানস্থলে বড় নেতা, পাতিনেতা-নেত্রীরা মুখ শুকনো করে বসে আছেন। তাঁরা গণ-অনশন করছেন। আর অনুষ্ঠানস্থলের পেছনে চলছে গণহারে ভূরিভোজ!
ভূরিভোজের দৃশ্য দেখে আবদুর রশিদের চেহারায় খুশির ঝিলিক! খাবার দেখে তাঁর ক্ষুধা গেল বেড়ে। তিনি মহানন্দে খেতে শুরু করলেন। তাঁর পাশে বসে বশির উদ্দিন বললেন, কি রশিদ ভাই, বলছিলাম না, ভূরিভোজ হবে! আমার কথা সত্যি হলো তো!
জি জি, এক শ বার সত্যি। হাজারবার সত্যি।
এবার গণ-অনশনের মানে বুঝলেন তো!
জি, ভূরিভোজ!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.