সদরে অন্দরে-এত শিক্ষার্থীর মৃত্যুতেও কাঁদে না যে শিক্ষকের মন! by মোস্তফা হোসেইন

শোকের চাদরে ঢাকা পড়েছিল সারা দেশ। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকার পাশেই উত্তোলিত হয়েছিল কালো পতাকা। শোকাবহ সেই পরিবেশ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তারা বুকে ধারণ করেছিলেন শোকের প্রতীক কালোব্যাজ।


এত কালোর ছোঁয়া, সে কি অভিভাবক মহল কিংবা অন্য সাধারণ মানুষকে না ছুঁয়ে পারে? পারার কথাও নয়। প্রতিটি মানুষ যেন কেঁদেছে গত কয়েকটি দিন। চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার দুরন্ত সেই ৪৪ শিশু-কিশোরের প্রাণ হারানোর খবরে গোটা দেশই শোকাহত হয়ে পড়েছিল।
টেলিভিশনের পর্দায় আমরা দেখেছি শোকাবহ সেই ঘটনা এবং ঘটনা-পরবর্তী সব দৃশ্য। টেলিভিশনের ক্যামেরা যাচ্ছে মিরসরাইর সেই গ্রামগুলোতে। মা-বাবার সন্তান হারানোর বিলাপ প্রচার হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। পত্রিকার পাতা ভরে আছে সেই বিয়োগান্ত দৃশ্যের ছবিতে। ৪৪ শিশু-কিশোরের মা-বাবা এবং নিকটজনের প্রতি একাত্মতা জানাতে যখন জাতীয়ভাবে শোক পালন করা হয়েছে, ওই সময় কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ কী পারে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠতে? আর সেই আনন্দ উৎসবটা যদি হয় মিরসরাইর চারটি স্কুলের মতোই কোনো স্কুলে, আর ওই উৎসবের আয়োজক যদি হয় স্কুলেরই কর্তৃপক্ষ, এবং যিনি এই উল্লাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু, তিনিও যদি হন একজন অধ্যাপক, তাহলে কিভাবে হিসাব মিলানো হবে সেই উল্লাসের? নিশ্চয়ই দুর্বিসহ লাগবে সেই চিত্র। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেরকমই একটি দৃশ্য দেখলাম যশোর বোর্ডের অধীন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সংবর্ধিত হয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল বাসার। সংবাদে প্রকাশ, সেই স্কুলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নাচ-গানও হয়েছে। সকাল ১১টায় ওই স্কুলে বোর্ডের চেয়ারম্যান উপস্থিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন।
চেয়ারম্যান সাহেব বোর্ডের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা কাজে তাঁর কাছে যেতে হয়। সুতরাং চেয়ারম্যানকে সন্তুষ্ট করার চিন্তা তারা করতেই পারে। আবার বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও সংবর্ধিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু যে সকালবেলা জাতীয় সংগীতের সময় স্কুলে উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সৃষ্টিকর্তার কাছে মিরসরাইয়ে নিহত শিক্ষার্থীদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করার কথা, ঠিক সেই সময় তিনি নিজ গলা বাড়িয়ে দিলেন ফুলের মালা পরার জন্য! নিজে উপভোগ করলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অন্তত একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে তা-ই জানা গেছে।
চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই জানতেন, ১৩ জুলাই বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিরসরাইয়ে নিহত শিক্ষার্থীদের জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন। স্কুলগুলোতে মিলাদ ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সংবাদ তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। সরকারও তেমনি একটি নির্দেশিকা দিয়েছে আগের দিনই। তিনি কি একবারের জন্যও প্রশ্ন করেছিলেন বারাদি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে এসব বিষয়ে? বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি স্কুলগুলোর অভিভাবকতুল্য। একবারও কি তাঁর মনে হয়েছিল, সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের মর্মান্তিক বিদায়ে আনন্দ করার মতো নির্মমতা আর কিছু হতে পারে না। তিনি যদি স্কুলে ঢুকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে অ্যাসেম্বলিতে যেতেন, যদি তিনি সেখানে শ্রদ্ধা জানাতেন, মোনাজাত পরিচালনা করতেন কিংবা মোনাজাতে অংশ নিতেন, তাহলে মনে হয় সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকত তার বারাদি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সফর। অ্যাসেম্বলিতে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তৃতা করে সহমর্মিতা জানাতে পারতেন। তাহলে শিক্ষার্থীরা কিছু শিখতেও পারত। অন্তত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটত। তারা বুঝতে শিখত, তাদের মতো যারা আছে, প্রত্যেকের সঙ্গেই আ@ি@@@ক সম্পর্ক রয়েছে তাদের। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তিনি এর কিছুই করলেন না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালীদের সংবর্ধনা প্রদানের সংস্কৃতি আমাদের এখানে নতুন কিছু নয়। এই সংবর্ধনা প্রদানের পেছনে যে এক ধরনের উৎকোচ প্রদানের মানসিকতা কাজ করে, বোধ করি তা সবাই মেনে নেবেন। এই উৎকোচ এতটাই খোলামেলা যে, কখনোই মনে হয় না, এর পেছনে কোনো স্বার্থচিন্তা জড়িয়ে আছে। এখানে উৎকোচ গ্রহণকারী ব্যক্তি নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ভান করেন। আর যাঁরা উৎকোচ দেন, তাঁরা বাজার থেকে মাছ কিনে নিয়ে পুকুরের সেরা মাছটি উপহার হিসেবে এনেছেন বলতে দ্বিধা করেন না। এই সংবর্ধনা দেওয়া হয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদেরও। আইন-কানুন, পরিবেশ-পরিস্থিতি কোনোটাই তাঁদের সংবর্ধনা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। যখনই দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়, তখনই সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের এই সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অত্যন্ত অমানবিক বলে বিবেচিত হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কচি কচি শিক্ষার্থীদের কড়া রোদে দাঁড় করিয়ে রাখার সংবাদও আমাদের দেশে অসংখ্যবার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ হয়তো রোদে টিকতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু সংবর্ধনা নিতে ভুল করেননি প্রভাবশালী নেতা।
এই সংবর্ধনা সংস্কৃতিতে সংবর্ধনা প্রদানকারীদের সাধ্য নিয়ে হিসাব চলে না। একটি গরিব এলাকার এমপিও যখন ৮০ ভরি স্বর্ণের নৌকা উপহার পান, তখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না, ওই উপঢৌকনের পেছনে কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে। ওই স্বর্ণের নৌকা উপহার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারী নিজেরা চাঁদা দিয়ে স্বর্ণের নৌকা বানিয়েছেন। উপহার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিজেদের উদ্দেশ্যকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেন এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার পর। কেউ আবার যুক্তিও তুলে ধরেন। রাজশাহী জাহানাবাদ দাখিল মাদ্রাসায় তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় এমপি (পবা-মোহনপুর, রাজশাহী-৩ নির্বাচনী এলাকা) মেরাজউদ্দিন মোল্লা ওই মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির জন্য তদবির করেছিলেন। সফল এমপি সাহেব সেই মাদ্রাসায় গেলে তাঁকে স্বর্ণের নৌকা উপহার দেওয়া হয়। আর সেই নৌকাটি তৈরি করা হয় ওই মাদ্রাসার শিক্ষকদের দেওয়া চাঁদার টাকায়। এখানেই প্রশ্ন আসে, এমপিওভুক্তির কারণে যেসব শিক্ষক উপকৃত হয়েছেন, তাঁরাই মূলত এই অর্থ ব্যয় করেছেন। আর এই উপঢৌকন গ্রহণকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এমপি সাহেব বললেন, স্থানীয় মানুষ যখন ভালোবেসে কিছু উপহার দেয়, তখন তিনি তাদের বিমুখ করেন কিভাবে? স্বল্প বেতনের শিক্ষকদের এই চাঁদা প্রদান করা যে কতটা বেদনাদায়ক, সেটা তাঁরা প্রকাশ না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। তেমনি অসুবিধা হয় না প্রখর রোদের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে রেখে কোনো ব্যক্তিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য কতটা কষ্ট সইতে হয়। অথচ যাঁরা সংবর্ধিত হন, তাঁরা কখনো চিন্তা করেন না, এই সংবর্ধনার যৌক্তিকতা কতটুকু। এটা কি আসলেই তাঁর কাজের মূল্যায়ন, নাকি এর পেছনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য রয়েছে।
সংবর্ধিত হওয়ায় কারো মনে যদি সামান্য পরিমাণ দুঃখবোধও জন্ম নেয়, তাহলে সেই সংবর্ধনাকে অযৌক্তিক ও নীতিবিবর্জিত বলতে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়। আমাদের সমাজের প্রভাবশালীরা সংবর্ধিত হয়ে সেই সত্যটিই প্রমাণ করেন। আরো দুঃখজনক হচ্ছে, সেই প্রমাণটি তাঁদের চোখে ধরা পড়ে না। যেমনি কুষ্টিয়ায় বোর্ডের চেয়ারম্যান সাহেবও বুঝতে পারেননি, এই সংবর্ধনা জাতীয় অনুভূতিকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ করছে। আর যাঁরা সংবর্ধনা দিয়েছেন, তাঁদেরও এমন কিছু উদ্দেশ্য আছে, যা বাস্তবায়ন করাটা চেয়ারম্যান সাহেবের দায়িত্বভুক্ত। নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালনের প্রয়োজনে এই সংবর্ধনার উপঢৌকন নেওয়াটা কি যথাযথ বলে মনে করেন তিনি। তাও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যাপিত একটি
শোকাবহ দিবসে?
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.