শিল্পীর ভুবন-প্রাচ্যের ক্যাকটাস by সিলভিয়া নাজনীন

‘ঘটনাগুলো সব আগে থেকেই ঘটে আছে, আমরা তার ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করি’—এমন দার্শনিকসুলভ চিন্তা একজন শিল্পীকে সহজেই মানিয়ে যায়; শিল্পী নাসরীন বেগমের এমন উক্তিকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েই কথোপকথন চলছিল তাঁর স্টুডিওতে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় বোঝা গেল তিনি অন্য শিল্পীদের থেকে নানা কারণেই আলাদা।


বাইরে একটা অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলে রাখলেও ভেতরে সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। তাঁর ‘ক্যাকটাস’ সিরিজের মতোই কণ্টকাকীর্ণ বহিরাবরণ শুধু পারিপার্শ্বিকতাকে বিভ্রান্ত করে। দৃঢ় মনোবল, সত্তার স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং নিজের ওপর অবিচল আস্থা শিল্পী নাসরীন বেগমকে আলাদা করে দিয়েছে অন্য সবার থেকে। তাঁর শিল্পকর্ম নিজস্ব ব্যক্তিত্বেরই আলাদা গড়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ করা বাসার একটি কক্ষই শিল্পীর স্টুডিওতে রূপান্তরিত হয়েছে। একই সঙ্গে এই স্টুডিও, স্টাডিরুম এবং ডাইনিংরুম হিসেবেও ব্যবহূত হচ্ছে কক্ষটি। দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করেন তিনি। প্রত্যেকটি রেখা, বিন্দু, রঙের স্তরবিন্যাস, ফর্মের ডিস্ট্রিবিউশনে জড়িয়ে থাকে তাঁর চুলচেরা মনোযোগ। ক্যানভাস, রং, তুলি, গ্লাস, টেবিল, চেয়ার, ইজেলের এখানে সহাবস্থান। শিল্পী নাসরীন বেগমের বহিরাবরণের দৃঢ়তা স্টুডিওর অন্দরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিল্পী নাসরীন বেগম ক্যাকটাসেরই যেন মানবী সংস্করণ। ‘আমার ছবিতে প্রধান বিষয় হিসেবে এসেছে অনেকবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে। কখনো ক্যাকটাসে ফুল দিয়েছি, আগে ক্যাকটাসের ছবিগুলোতে চোখ ছিল না, ঠোঁট ছিল। পরে চোখ, তাকানো এসব স্তরে স্তরে, যা আমার জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি করে।’
তাঁর কাজের ধরনে একটি বিশেষ বিশেষত্ব পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিল্পীরা যে যেভাবে জীবন যাপন করেন, তাঁর স্টাইলও তেমন হয়ে যায়। আমি জলরংকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম, কারণ এর গুরুত্ব তখন কম ছিল। আমরাও (ওরিয়েন্টাল ঘরানা) ক্যানভাসে ছবি আঁকতাম, অথচ তা যেন আমার চরিত্রের সঙ্গে যায় না। তুমি যদি নিজেকে বোঝো, জানো তবে তোমার স্টাইল হবে, এর জন্য আলাদা কিছুর প্রয়োজন নেই। স্টাইল বিষয়টি আমাদের মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। একাডেমিতে আমাদের স্টাইল তৈরি করতে বাধ্য করে। ব্যাকরণ তো জানতে হবে। শিল্পীদের মূলত স্টাইল মানে হলো যা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারে না, এটা সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।’
কাজের বিষয়বস্তু, ধরন এবং উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্পী নাসরীন বেগমের অবস্থান পরিষ্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য সিরিজ ‘দরজা’, ‘পাতা’ আর ঘুরেফিরে বারবার আসে ‘ক্যাকটাস’। ক্যাকটাসের প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং তার নিজস্ব যাপন পদ্ধতির সঙ্গে অদ্ভুত মিল এই চিত্রকল্পকে নিয়ে আসে তাঁর ক্যানভাসে। সময়ের বিবর্তন এবং প্রতিবন্ধকতাকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর ডোর এবং লিফ সিরিজে। প্রাচ্যকলাশৈলীতে তাঁর ভাবনার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি, ‘আমার ওরিয়েন্টাল স্টাইল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেত। ওরিয়েন্টালে গ্রামারের বাইরে যাওয়া যায় না। তাই এ মাধ্যমে নতুন কিছু নির্মাণ ভীষণ কঠিন ছিল। ভারতে পড়তে যাওয়ার পর সহপাঠীদের বিরূপ আচরণ আমার মানসিক গড়নকে বদলে দেয়। এ ছাড়া আর্ট ক্যাম্প বা ওয়ার্কশপ আমার শিল্পকর্মে নতুনত্ব তৈরি করে। কারণ সেখানে বিভিন্ন শিল্পীর কাজ দেখার সুযোগ হয়, নিজের পরিবর্তন আসে। আমার সিরিজে প্রতিবারই বদল আসে। আসলে নিজেকে সময়ের সঙ্গে বদলে নিতে হয়।’
নারী শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রতিবন্ধকতাকে তিনি চিহ্নিত করেন এই বলে, ‘আমার মনে হয় পৃথিবীটা পুরুষের জায়গা আর নারী সেখানে নিজের একটু জায়গা নির্মাণ করে নেয়।’ নারীরা আত্মোপলব্ধির জায়গায় অনেক শক্তিশালী। এই শক্তিটাকে বাইরে প্রকাশ করা ভীষণ জরুরি।
শিল্পী নাসরীন বেগম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগে চেয়ারম্যান হিসেবে কর্তব্যরত।

No comments

Powered by Blogger.