যশোরে ১৩ মাসে ১১০ হত্যা by মনিরুল ইসলাম

যশোরে খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ১৩ মাসে ১১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে গত বছর (২০১১) ৯৭ জন ও গত জানুয়ারি মাসে ১৩ জন খুন হন, যা গত ছয় বছরের মধ্যে বেশি। যশোর পুলিশ ও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ খুনের সঙ্গে কিশোরেরা জড়িত।
হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি বড় অংশ ঘটানো হচ্ছে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা চাকু দিয়ে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে মাদক, প্রেমঘটিত পূর্বশত্রুতাসহ বিচ্ছিন্ন একাধিক ঘটনা।
পুলিশ সুপার কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলোর তদন্তের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ খুনের সঙ্গে উঠতি বয়সী কিশোরেরা জড়িত।
পুলিশ সুপার বলেন, সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় যশোরে অপরাধ প্রবণতা একটু বেশি। অপরাধের সুযোগও বেশি। অপরাধ সংঘটনের জন্য যেসব উপাদান দরকার হয়, তা-ও সহজে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এ জন্য কিশোরদের হাতে হাতে চলে গেছে ছুরি-চাকু।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্র জানায়, গত বছর যশোর জেলায় ৯৭ জন, ২০১০ সালে ৮২ জন, ২০০৯ সালে ৮৭ জন, ২০০৮ সালে ৬৪ জন, ২০০৭ সালে ৬৩ জন ও ২০০৬ সালে ৭৫ জন খুন হয়।
গত বছরের ৯৭টি খুনের মামলায় জড়িত অভিযোগে ১২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৪টি মামলার তদন্ত শেষে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র ও ১০টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ।
সংশোধনের জন্য কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র: খুনের অভিযোগ ওঠা ওই কিশোরদের গ্রেপ্তার করে সংশোধনের জন্য আদালতের মাধ্যমে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পর তারা আবার জামিনে মুক্তি পাচ্ছে।
যশোরের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র সূত্র জানায়, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে গত মাসে ২৮ জনকে সেখানে পাঠানো হয়। এর মধ্যে চারজন যায় খুনের মামলায়।
এ ছাড়া গত বছর খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন আদালতের মাধ্যমে ৩৮৬ জনকে এই কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৪১ জনের বিরুদ্ধে ছিল খুনের অভিযোগ। ২০১০ সালে ওই কেন্দ্রে পাঠানো ২০৭ জন কিশোরের মধ্যে ২৯ জন এবং ২০০৯ সালে ১৭১ জনের মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ছিল।
তিন বছরে খুনের মামলায় পাঠানো মোট ৮২ জন কিশোরের মধ্যে দুটি মামলায় দুই কিশোরকে সাজা দেওয়া হয়েছে। অন্য ৮০ জন কিশোরের মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৬৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে আদালত জামিনে মুক্তি দিয়েছেন।
খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেল জংশন ও বেনাপোল সীমান্তে মাদক বহনের জন্য কিশোরদের ব্যবহার করা হয়। এই মাদক থেকেই কিশোরদের একটা অংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তা ছাড়া দারিদ্র্য, পারিবারিক অস্থিরতা ও রাজনীতিতে ব্যবহার করার কারণে কিশোরেরা অসহিঞ্চু হয়ে উঠছে।
চাকু দিয়ে খুন: ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোরে অধিকাংশ খুন হয়েছে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা চাকু দিয়ে, যা প্রায়ই কিশোরদের পকেটে মিলছে।
যশোর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং ধর্ষণ, ময়নাতদন্ত, বয়স নির্ণয় ও জখমি সনদ প্রদানবিষয়ক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারি মাসের ১৩টি খুনের মধ্যে সাতটিই হয়েছে ছুরি-চাকু ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে। এ ছাড়া গত বছরের খুনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ৭০ শতাংশ খুন হয়েছে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ছুরি-চাকু দিয়ে।
যশোরের সহকারী পুলিশ সুপার (‘ক’ সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, যে ধরনের চাকু দিয়ে উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরা খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে, আইন অনুযায়ী তা অস্ত্রের মধ্যে পড়ে না। এ জন্য চাকুসহ কিশোর অপরাধীদের আটক করেও তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
আনিছুর রহমান বলেন, এরই মধ্যে যশোর শহরের কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু চাকু উদ্ধার হয়েছে। তবে দোকানদারেরা আর কিশোরদের কাছে ছুরি-চাকু বিক্রি করবেন না বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
শহরের বিপণি বিতান হাটবাজারের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা চাকু প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ নয়। এ জন্য ওই চাকু বিক্রি করতাম। একপর্যায়ে বখাটেরা এই চাকু কিনতে বেশি আগ্রহ দেখানোয় ২০০৭ সালের পর তা বন্ধ করে দিয়েছি।’
কৌশলে জামিনে মুক্ত: যশোরের মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটির ফায়ারিং রেঞ্জ-সংলগ্ন এলাকায় গত ৯ জানুয়ারি ইজিবাইকের চালক সেলিমের গলায় ছুরি মেরে খুন করা হয়। এই খুনের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে পুলিশ মণ্ডলগাতি গ্রামের কাইয়ুম, কৃষ্ণবাটি গ্রামের শামীম ও আরিফুল এবং চাঁচড়া মধ্যপাড়া গ্রামের হায়দারকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। এর মধ্যে কাইয়ুমের বয়স ১৯ বছর। অন্যদের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। আদালত কাইয়ুম ছাড়া অন্যদের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র পাঠান।
কাইয়ুম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, সে একটি মেয়েকে ভালোবাসত। কিন্তু ইজিবাইকের চালক সেলিমের সঙ্গে ওই মেয়ের প্রেম হয়। সেই ক্ষোভে কাইয়ুম তার চার বন্ধুকে নিয়ে সেলিমের হাত ও মুখ বেঁধে গলায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সন্তু বিশ্বাস বলেন, শামীম এসএসসি পরীক্ষার্থী আর হায়দারের ফুসফুসে ছিদ্র। তার জীবনের আয়ু আছে ছয় মাস। ইতিমধ্যে সাড়ে পাঁচ মাস পার হয়েছে। চিকিৎসকের কাছ থেকে এই মর্মে একটি সনদ এনে আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ জন্য আদালত ওই দুজনের সঙ্গে আরিফুলকে জামিন দেন। অন্যদিকে মামলার প্রধান আসামি রিমন পলাতক।
এসআই সন্তু বিশ্বাস বলেন, এদিকে কাইয়ুমকে কিশোর দাবি করে তাকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে আদালতের কাছে আবেদন করেছে তার পরিবার।
একসঙ্গে সবাই: খুনের মামলায় অভিযুক্ত কিশোরদের সঙ্গে অন্য কিশোরদেরও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। এতে নিরাপত্তা হেফাজতে বা ছোটখাটো অপরাধে আসা কিশোরেরা ওই কিশোরদের সংস্পর্শে এসে হিংস্র হয়ে উঠছে।
কেন্দ্র সূত্র জানায়, গত বছর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা দুই কিশোরকে অপর কয়েকজন কিশোর গলা কেটে খুন করে। এ বিষয়ে তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শেফিনা বেগমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে তাঁর দেওয়া প্রতিবেদনে কিশোরদের নৈতিক শিক্ষাদানসহ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
এ ব্যাপারে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, আসনস্বল্পতার কারণে খুনের মামলার আসামি কিশোরদের আলাদা রাখার সুযোগ নেই।

No comments

Powered by Blogger.