চারুশিল্প-বাস্তবতা, শিল্পী ও স্বপ্ন by জাফরিন গুলশান

এ কথা সত্য যে আজকের শিল্পকলা অন্য যেকোনো সময়ের শিল্পকলার চেয়ে ভিন্নতর। বিজ্ঞান ও কারিগরির ক্রম-অগ্রসরমাণ চেতনা, পরিচিত জগতের বাইরে মানুষের বিচরণ, রহস্যময় অন্তর্জগতের ক্রমউন্মোচন, ভার্চুয়াল সামাজিক সম্পর্ক, সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির বিশ্বজনীন সংকট—সব মিলিত হয়ে এই যুগের মানুষের জীবনযাত্রা অন্য সব সময়ের চেয়ে আলাদা। এখনকার শিল্পও তাই অনেক বেশি বিশ্লেষণাত্মকভাবে অধিকারপ্রবণ এবং বহুচরিত্র অবলম্বনকারী।


শিল্পী যতভাবেই প্রকাশ করতে চান নিজের বক্তব্য, শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেন সামগ্রিক চিন্তায়। শিল্পী নরিকো ইয়ানাগিসাওয়া ‘ড্রিমস অব ল্যান্ড’ শিরোনামের একক চিত্র প্রদর্শনীটিতে শেষাবধি ফিরেছেন আত্মকেন্দ্রিক মানুষের যৌথ জীবনের ঐতিহাসিক সমগ্রতায়। মানুষের অস্তিত্বের স্বরূপতা নিয়ে ভাবিত। জীবনকে দেখেছেন ফসিলের মতো, অনেক পূর্বের সঙ্গে সম্পর্কিত ফলাফল থেকে যায় ধারাবাহিক বর্তমান অস্তিত্ব হিসেবে। ছাপচিত্রের মাধ্যমে যেভাবে একটি জিংক বা কপার প্লেটকে অ্যানগ্রেডিং করে, কাগজে শুধু ফলাফলের ছবি রয়ে যায়। হারিয়ে যায় মূল মাধ্যম। জীবনও সে রকম। সব প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলোর অভ্যন্তরের বিষয় একধরনের ‘বেদনা’। মানুষ, গাছ, ঘর, নদী, পশু ইত্যাদি স্বাভাবিক জীবনের অনেক উপাদানই এসেছে শিল্পীর ছবিতে। ছাপচিত্র মাধ্যমের শিল্পকর্মগুলো নান্দনিক বিচারে উপভোগ্য। বর্ষীয়ান এই শিল্পীর সততা ও নিষ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছাপাই ছবিতে। নিজের কাজ সম্পর্কে শিল্পী বললেন, ‘পৃথিবীতে আমাদের সুন্দরভাবে বাঁচার অন্তরায় সমস্যাগুলোকে অনুভব করি গভীরভাবে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক এবং বাহ্যিক যন্ত্রণাগুলোকে দেখি। অভিজ্ঞতা হয়। সেগুলো আঁকি। ফসিল এসেছে প্রতীকী আকারে, যা আমার কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাখার ব্যবহার করেছি এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের প্রতীক হিসেবে।’ শিল্পী নরিকো ইয়ানাগিসাওয়ার অ্যাচিংগুলোতে ড্রয়িং শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে আঙ্গিকগত স্থান থেকে। বিবিধ গ্রেডের পরিমার্জিত নান্দনিক তৃপ্তিদায়ক আবহ ও চিত্রের তলে নানাবিধ টেক্সচার, চর্চিত অভিজ্ঞতার সুচিন্তিত ফসল। স্থান তথা দেশ বিভাজন ঘটেছে আঙ্গিকের গড়নের সঙ্গে সাযুজ্যতায়। চিত্রমালায় স্বপ্নের চরিত্র আবেশ। রং ব্যবহার-পরিশীলিত। মূল দৃষ্টি কেন্দ্রস্থলকে কখনো রঙের দ্বারা চিহ্নিত করেছেন দর্শকের সামনে, কখনো বিন্যস্ত করেছেন রঙের বিচরণ। মানুষের অবয়ব নিয়ে নানা কম্পোজিশনে গল্প বলেছেন। মানুষের বোধের স্পর্শকাতরতার সীমাহীন যন্ত্রণা এবং আনন্দের সংমিশ্রণের প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। ছাপচিত্রের কৌশলগত দিকে শিল্পীর সুচিন্তিত ও দীর্ঘ কর্ম অভিজ্ঞতার নান্দনিক মনোযোগ সহজেই বোধগম্য। জাপানি এই শিল্পীর চিত্রে, চিত্রের রেখা ও আঙ্গিকের গঠনে জাপানের হাজার বছরের ছাপচিত্র মাধ্যমের উৎকর্ষের উপস্থিতি। ‘জার্নি ইন টু প্রাইমাল সেন্স’, ‘গার্ডেন অ্যাট দ্য ওয়াটার ফ্রন্ট’, ‘লিংগারিং নাইটমেয়ার’, ‘ফ্লেগমেন্ট’, ‘প্যাথোস’, ‘লুমিনিয়াস’ ‘ড্রিমস অব দ্য ল্যান্ড’ শিরোনামে প্রতিটি একেকটি সিরিজ চিত্রকর্ম একত্র করেছেন প্রদর্শনীতে। নান্দনিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এই শিল্পী। শিল্পী নরিকো ইয়ানাগিসাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত ছাপচিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার সঙ্গে একই শ্রেণীতে জাপানে পড়েছেন। ফলে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা রয়েছে। যদিও এ দেশের শহরের চেয়ে গ্রাম পছন্দ তাঁর। আধুনিক শিল্প প্রসঙ্গে দুর্বোধ্যতা প্রশ্নে সাধারণ দর্শকেরা শিল্পীদের দোষারোপ করেন। সে ক্ষেত্রে প্রদর্শনীটি দর্শকদের জন্য আনন্দদায়ক। ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া চমৎকার এ প্রদর্শনীটি চলবে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
শিল্পী নরিকো ইয়ানাগিসাওয়া: জন্ম ১৯৪০ সালে জাপানে। বর্তমানে জাপানের মুসাশিনো আর্ট ইউনিভার্সিটিতে প্রিন্টমেকিং কোর্সে অধ্যাপনা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.