হারিয়ে যাচ্ছে ঢেঁকি

'ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে'_ বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধরে প্রচলিত হয়ে এলেও এখন আর ঢেঁকি ধান ভানে না। অথচ এক সময় গ্রামবাংলায় ধান ভানার প্রধান যন্ত্র ছিল ঢেঁকি। চাল ভানাসহ অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। ঢেঁকি প্রধানত ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বানানো কাঠের তৈরি কলবিশেষ।
ঢেঁকিতে প্রায় ছয় ফুট লম্বা এবং ছয় ইঞ্চি ব্যসবিশিষ্ট একটি কাঠের ধড় থাকে। মেঝে থেকে প্রায় ১৮ ইঞ্চি উচ্চতায় ধড়ের একেবারে সামনে ২ ফুট লম্বা একটি গোল কাঠ থাকে। এটিকে মোনা বলা হয়। দুটি খুঁটির ভেতর দিয়ে একটি ছোট হুড়াকা থাকে। এ হুড়াকার ওপরই ধড়টি ওঠানামা করে। এ দিয়েই এক সময় ধান ভানিয়ে চাল বানানো হতো। পিঠা তৈরির জন্য চালের গুঁড়া বানানো হতো।

এক সময় বাংলার গ্রামে নতুন ফসল তোলার পর ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠত। প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকিঘর থাকত। কিন্তু ঢেঁকি এখন আর ধান ভানে না। কালের ব্যবধানে এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এ ঢেঁকির ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। যান্ত্রিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ঢেঁকির অস্তিত্ব আজ বিলীন। সর্বোপরি বলতে গেলে ঢেঁকি আজ যেন রূপকথার গল্পের মতো।
মনিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি জানান, কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। আশির দশকে ঢেঁকিতে ধান ছাঁটাই করে চাল বানানোর পাশাপাশি তৈরি করা হতো চালের গুঁড়া। চালের গুঁড়া দিয়ে শীতে প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি করা হতো হরেক পিঠা-পুলি। বইতো উৎসবের আমেজ। বর্তমান আধুনিক যুগে সেই ঢেঁকির পরিবর্তে ধান ছাঁটাইসহ চালের গুঁড়া তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎচালিত মেশিনে। বর্তমান চাল ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎচালিত মেশিনে ধান ছাঁটাই করার পর ওই চালে ইউরিয়া সার দিয়ে পালিশ করে তা চকচকে করে বাজারজাত করছে বলে প্রচার রয়েছে। হানুয়ার গ্রামের জামির গাজীর স্ত্রী জোহরা বেগম (৭৫) জানান, যখন এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না তখন ঢেঁকিই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। ঢেঁকিতে চাল ছাঁটাই করতে তখন তাদের মনে অনেকটা আনন্দই লাগত। গৃহবধূরা মনের আনন্দে 'ও ধান ভানোরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া/আমি নাচি ঢেঁকি নাচে হেলিয়া-দুলিয়া, ও ধান ভানোরে' গানটি গাইতেন এবং গানের তালে তালে ঢেঁকি পাড় দিতেন।
আজ সেসব যেন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
রাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা এসএম কওসার আহম্মেদ, তোফাজ্জেল হোসেন ও আবদুল মান্নান জানান, ঢেঁকির ছাঁটাই চালের ভাত শুধু লবণ দিয়ে খেতে ভালো লাগত। আর বর্তমান ইউরিয়া মেশানো চালের ভাত খেতে খেতে ঢেঁকি ছাঁটাই চালের ভাতের স্বাদ একেবারে ভুলেই গেছি। তারা জানান, বর্তমানে একটি ঢেঁকি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় বিশ হাজার টাকা। তার ওপর ঢেঁকি তৈরি করতে ভালো বাবলা কাঠের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এলাকায় ভালো বাবলা গাছ পাওয়া যায় না।

No comments

Powered by Blogger.