শবেবরাতের তাৎপর্য by মাসুদা বেগম

১৪ শাবানের দিবাগত রাত লাইলাতুল বারাত বা শবেবরাত নামে অভিহিত। এই পবিত্র রাতে নিহিত রয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ, তেমনি রয়েছে বহু তাৎপর্য, ফজিলত ও বরকত। তাই এ রাতকে বলা হয়েছে লাইলাতুল বারাত বা মুক্তির রাত। অন্যদিকে পবিত্র মাহে রমজানের আগের মাস হওয়ায় শাবানকে বলা হয়েছে রমজান শরিফের প্রস্তুতির মাস।


প্রিয় নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, 'শাবান মাস হলো আমার মাস, আর পবিত্র রমজান মাস হলো মহান আল্লাহ তায়ালার মাস।' প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, 'তোমরা রমজানের জন্য শাবান মাসের চাঁদের সঠিক হিসাব রেখো। কেননা, শাবানের হিসাব সঠিক হলে রমজানের চাঁদের হিসাব নিয়ে মতভেদ হবে না।' (মিশকাত শরিফ, ১১৫ পৃষ্ঠা)
পবিত্র মুসলিম শরিফে বর্ণিত রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েক দিন ছাড়া পূর্ণ শাবান মাস রোজা রাখতেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে অন্যান্য মাসের তুলনায় শাবান মাসের রোজা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অধিক প্রিয় ছিল।
'শব' অর্থ রাত বা রজনী; আরবি 'বারাতুন' অর্থ নাজাত বা নিষ্কৃতি, মুক্তি, পরিত্রাণ প্রভৃতি। পবিত্র হাদিস শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী এ রাতটি হচ্ছে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাত। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, 'লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান' অর্থাৎ শাবানের মধ্যভাগের রাত্রি। লাইলাতুল বারাতে উম্মতে মুহাম্মদি একাগ্রচিত্তে তওবা, ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগির দ্বারা স্বীয় গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের ভয়াবহ পরিণতি থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে চিরস্থায়ী আবাসস্থল জান্নাতের পথ সুগম করে বলেই এর নামকরণ হয়েছে শবেবরাত বা নাজাতের রজনী। লাইলাতুল বারাত অর্থ গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের রাত। এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে মুমিন মুসলমানদের গুনাহ মাফ হয়ে থাকে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
পবিত্র শাবান মাসের ১৫তম রাত বা শবেবরাত সম্পর্কে রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা শবেবরাতের রজনীতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে এবং দিনের বেলা রোজা রাখবে।' (মিশকাত)
'লাইলাতুল বারাত' শব্দের অর্থ হলো গুনাহ থেকে মুক্তির রজনী। এই পবিত্র রজনীতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গুনাহগার বান্দাদের গুনাহ মাফের উত্তম সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।
প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমাদের সামনে যখন শাবানের ১৫তম রজনী উপস্থিত হয় (অর্থাৎ শবেবরাতের আগমন হয়), তখন তোমরা সে রাতটি জাগ্রত থেকে কাটাও, নামাজ পড়ো, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করো, তসবিহ পড়ো, জিকির করো, দোয়া করো ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে রাতটি কাটাও আর দিনের বেলায় রোজা রাখো। কারণ, এদিনের (১৪ শাবানের) সূর্যাস্তের পরক্ষণেই মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে ফজর পর্যন্ত নূরের তাজালি্লর বিচ্ছুরণ ঘটান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়_এমন কোনো গুনাহগার বা নাফরমান ব্যক্তি আছো কি? যে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে? আমি তার গুনাহ মাফ করে দেব। কোনো দারিদ্র্যক্লিষ্ট আছো কি, যে কষ্ট মেটানোর জন্য আমার কাছে দোয়া করবে? আমি তার জন্য আমার রিজিকের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছো কি, যে আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করবে? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দেব।'
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'সারা রাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এরূপ ঘোষণা দেওয়া হয়ে থাকে এবং বান্দাদের ওপর আল্লাহর অজস্র ধারায় রহমত নাজিল হয়ে থাকে।' (ইবনে মাজাহ, ১৫৫ পৃ.)
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে সম্বোধন করে বললেন, তুমি কি জানো এ রাতে অর্থাৎ শবেবরাতের রাতে কী রয়েছে? আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) দয়া করে একটু বলুন এ রাতে কী রয়েছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আগামী বছর যত আদম সন্তান এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেবে এবং যারা মৃত্যুবরণ করবে, এ রাতে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়; বিশেষ করে এ রাতে বান্দাদের আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং তাদের রিজিক অবতীর্ণ করা হয়।' (মিশকাত শরিফ ১: ১১৫)।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) আরো বলেন, 'এক রাতে আমি নবীজিকে (সা.) তাঁর স্থানে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে নবীজি (সা.)-কে জান্নাতুল বাকি নামে কবরস্থানে গিয়ে দেখি তিনি আকাশপানে মাথা উত্তোলন করে দোয়া করছেন। নবীজি (সা.) তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! আমার কাছে হজরত জিবরাইল (আ.) এসেছিলেন।
তিনি আমাকে বলে গেছেন, আজ রাত হলো নিসফে শাবান অর্থাৎ লাইলাতুল বারাত। আজ যখন আল্লাহ তায়ালা এত অধিক পরিমাণে লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন, এমনকি কালব গোত্রের বকরিগুলোর যত পশম রয়েছে এবং অধিকসংখ্যক মানুষকে মাগফিরাত দান করবেন।' (মিশকাত শরিফ, ১১৫ পৃষ্ঠা)
হজরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.)-এর রেওয়ায়েতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের ১৫তম রাতে সব সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং সবার মাগফিরাত করে দেন। কিন্তু মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারীকে ক্ষমা করা হয় না (তাবরানি)। এমন কিছু দুর্ভাগা ব্যক্তি রয়েছে, যারা এই পবিত্র রজনীতেও ক্ষমা লাভ থেকে বঞ্চিত হবে। তারা হলো_(১) আল্লাহর সঙ্গে শিরক স্থাপনকারী, (২) হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী, (৩) অন্যায়ভাবে ট্যাঙ্ আদায়কারী, (৪) মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, (৫) অহংকারবশত পায়ের টাখনুর নিচে লুঙ্গি ও পায়জামা পরিধানকারী পুরুষ, (৬) জাদুকর ও ভাগ্য গণনাকারী, (৭) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, (৮) মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি এবং অন্যায়ভাবে হত্যাকারীকেও এ রাতে ক্ষমা করা হয় না। (বায়হাকি)।

লেখক : ধর্মীয় গবেষক

No comments

Powered by Blogger.