একুশে বইমেলা ২০১২-লেখকের মুখোমুখি

এবারের বইমেলায় তিন লেখকের উল্লেখযোগ্য তিন বই মুনতাসীর মামুন এবারের বইমেলায় আমার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা এবং উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ বিষয়ে। এর মধ্যে আছে মাওলা ব্রাদার্স থেকে শান্তি কমিটি ১৯৭১, ঢাকার স্মৃতি-১২, সুবর্ণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ১৩নং সেক্টর, অন্যরকম;


অনন্যা থেকে উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গের গরিব মানুষের জীবন, উনিশ শতকের বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র-এর ১৪তম ও শেষ খণ্ড, গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ-এর ১৩ ও ১৪তম খণ্ড; সময় প্রকাশন থেকে বিজয়ী হয়েও যা পারিনি এবং অ্যাডর্ন থেকে বেরিয়েছে সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর অনুবাদে আমার কিশোর উপন্যাস জয়বাংলার ইংরেজি সংস্করণ। এই মেলায় আমার কিছু বই পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে। আগামী এপ্রিলে সময় প্রকাশন থেকে বেরোচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকোষ -এর ১২টি খণ্ড।
আমার কাছে তো সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ বই।
তবে বিশেষভাবে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক দুটি বই, মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নং সেক্টর এবং শান্তি কমিটি ১৯৭১-এর কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথমোক্ত বইটিতে আমি ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে তৎকালীন বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে দেখানোর চেষ্ট করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো কেবল একটি বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং গোটা বিশ্বই এই যুদ্ধের সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় যুক্ত ছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের কথা জানি। আমি ১২ নম্বর সেক্টর বলতে বুঝি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে আর ১৩ নম্বর সেক্টর বোঝাতে চেয়েছি মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বের নানা অঞ্চলের সিভিল সমাজকে, যাদের ভূমিকা প্রত্যক্ষ যোদ্ধার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নং সেক্টর বইতে এ রকম ১০০টি বিবরণ স্থান পেয়েছে, যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হবে অগ্নিঝরা একাত্তরের সহমর্মী পৃথিবীর চেহারা।
শান্তি কমিটি ১৯৭১ বইটি এ কারণে তাৎপর্যবহ যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু এর পক্ষশক্তির ইতিহাস নয়, শত্রুশক্তিরও ইতিহাস। কিন্তু দেখুন, ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বিরোধী পক্ষ শান্তি কমিটির উদ্ভব ও তৎপরতা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। আমি আনন্দিত যে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকীর অব্যবহিত পরই এ বিষয়ে আমার বইটি প্রকাশিত হলো।
উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ আমার আগ্রহের আরেকটি বিষয়। এ বছর উনিশ শতকের বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্রর ১৪তম খণ্ড প্রকাশের মধ্য দিয়ে আমার পঁয়ত্রিশ বছরব্যাপী একটি গবেষণাকর্ম পূর্ণতা পেল। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় এটিই বোধহয় সর্ববৃহৎ সিরিজ এবং আমার পূর্বসূরি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিনয় ঘোষের কাজের পরিপূরক।
ইতিহাস তো কেবল উঁচুতলার মানুষের ক্ষমতা দখলের বিবরণ নয়। কিন্তু সিংহ ভাগ গরিব মানুষের কথা পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে খুব একটা আসেনি। সে দিক থেকে উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গের গরিব মানুষের জীবন বইটিও আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। এ কাজে আমার সহযোগী ছিলেন ড. মাহবুবুর রহমান।

ওয়াসি আহমেদ
এবারের বইমেলায় আমার একটি বই-ই এসেছে। কালাশনিকভের গোলাপ নামের বইটি প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর। এটি গল্পের বই, সব মিলিয়ে ১০টি গল্প রয়েছে এতে। নামগল্প ‘কালাশনিকভের গোলাপ’ গল্পটি বেড়ে উঠেছে একটি একে-৪৭ রাইফেলকে ঘিরে। বিশ্বখ্যাত বা কুখ্যাত এই অ্যাসোল্ট রাইফেলের যিনি নকশাকার, তিনি মিখাইল কালাশনিকভ। সামান্য ট্যাংক ড্রাইভার হিসেবে সোভিয়েত রেড আর্মিতে ঢুকে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাবেও ভূষিত হয়েছিলেন। মূলে ছিল তাঁর যুগান্তকারী উদ্ভাবন একে-৪৭, যাকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বসেরা কিলিং মেশিন। কালাশনিকভের নামেই রাইফেলটির নাম। কৌতূহলকর বিষয় হলো, কালাশনিকভ যৌবনে কবিতা লিখতেন এবং সারা জীবন কবিতাই লিখতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে নিঃসঙ্গ শুয়ে শুয়ে তিনি জার্মানদের টেক্কা দিতে সক্ষম একটি উন্নত রাইফেলের নকশা তৈরির কথাই ভাবতেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অদলবদলের পর যখন সত্যি সত্যি মনমতো নকশাটি তিনি করে ফেললেন এবং রেড আর্মিও সেটিকে লুফে নিল, তখন আর তাঁর পেছনে তাকানোর পথ রইল না। সময়টা ১৯৪৭ সাল, তাই রাইফেলের নামের সঙ্গে ৪৭ সংখ্যাটি সেই থেকে অবিচ্ছিন্ন রয়ে গেল। কিন্তু এদিকে এর উদ্ভাবক কালাশনিকভ পড়লেন মুশকিলে। তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন, বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর কাছে যেমন তার রাইফেলটি আদরনীয়, তেমনি পৃথিবীর আনাচকানাচে মুক্তিকামী বিপ্লবীদের হাতেও তা ঝলসে উঠছে। আবার ভাড়াটে খুনি, ডাকাত, সন্ত্রাসীদেরও এক নম্বর পছন্দ তাঁর মারণাস্ত্র। খ্যাতির নানা টানাপোড়েনে কালাশনিকভ রাতে ঘুম ভেঙে ঘরে পায়চারি করেন। ভাবেন, যদি একটা যুগান্তকারী কৃষিযন্ত্র বানাতেন ক্ষুধার পৃথিবীতে, যা হতে পারত অবিস্মরণীয় কীর্তি। কিন্তু তা কী করে হয়—এক জীবনে মারণাস্ত্র ও কৃষিযন্ত্র!
কালাশনিকভের গোলাপ বইটির কয়েকটি গল্পের প্রতি লেখক হিসেবে আমার পক্ষপাত রয়েছে। ‘পা’ গল্পটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জবানিতে ক্যানসার-আক্রান্ত তাঁর কাটা পা নিয়ে লেখা। এ ছাড়া অন্য কয়েকটি গল্প যেমন ‘নিরাপদ সন্ত্রাস’, ‘সুন্দিকাঠের আলমারি’, ‘উদ্ধার-পুনরুদ্ধার’, ‘ওয়ে আউট’ ইত্যাদি লিখতে গিয়ে উজ্জীবিত বোধ করেছি। বাহ্যিক বা ওপরতলের বাস্তবের খোলসে আড়াল অন্য বাস্তব, বলা যায় ইন্দ্রিয়াতীত বাস্তবের খোঁজ পেতেই আমার লেখালেখি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিমও বটে। কালাশনিকভের গোলাপ-এর গল্পগুলো এর ব্যতিক্রম নয় বলেই মনে করি।

আনিসুল হক
এ বছরের ফেব্রুয়ারি আমার জন্য বিশেষ একটা ফেব্রুয়ারি হয়ে যেন এসেছে। দিল্লি থেকে বেরোল ফ্রিডমস মাদার, আমার মা উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। দিল্লিতে প্রকাশনা উৎসব হয়েছে, ওখানকার কাগজে-টিভিতে খবর-টবর বেরোচ্ছে, ওরা খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে বলেই মনে হলো। বক্তারা খুব প্রশংসা করেছেন, প্রকাশক খুব আশাবাদী। দেখা যাক, কী দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের বইমেলায় গল্প-উপন্যাস-কলাম নানা রকমের বই-ই আমার বেরিয়েছে। আমি কিন্তু গত বছর গল্প-উপন্যাসের কোনো বই প্রকাশ করিনি। একটু প্রস্তুতি নিয়ে এবার করলাম। দুটো উপন্যাসের কথা আমি বিশেষভাবে বলতে চাই। একটা হলো, সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত না-মানুষি জমিন। নো-ম্যানস-ল্যান্ড নিয়ে লেখা। দুই দেশের সীমান্তে পুশআউট, পুশইন ইত্যাদি চলছে। এই সময় নো-ম্যানস-ল্যান্ডে একটা মানবশিশু জন্মগ্রহণ করেছে। সে কোথায় যাবে। আমার মনে হয়, এই উপন্যাসটি পাঠকদের বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে মানুষের মধ্যে মানবিকতাই যে প্রধান, এই উপাখ্যানে সেটা খুব নির্ভারভাবে দেখানো গেছে বলে আমার বিশ্বাস।
আর একটা উপন্যাসের দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই উপন্যাসটি আমি তিন বছর ধরে লিখছি। যার নাম, যারা ভোর এনেছিল। উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ করা হবে তার ছেলেবেলা থেকে, অনিবার্যভাবে আসবেন মওলানা ভাসানী বা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো ঐতিহাসিক চরিত্র, তাজউদ্দীন আহমদ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে আসবেন।
যারা ভোর এনেছিল উপন্যাসে তরুণ শেখ মুজিব খুবই উজ্জ্বল চরিত্র, তার কথাই স্বাভাবিকভাবে বারবার আসবে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংগ্রাম করেছেন, একেবারে শুরু থেকেই মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানিদের অপশাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সোচ্চার ছিলেন। তাঁকে বারবার গ্রেপ্তার করা হতো। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করা থেকে, সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকেননি। তিনি মৃত্যুভয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন, বাঙালিকে মৃত্যুভয়ের ঊর্ধ্বে তুলতে পেরেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তবে আমি মনে করি, বেগম মুজিব, যার ডাকনাম ছিল রেনু, তিনি এক অসাধারণ চরিত্র। বঙ্গবন্ধু যে বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন তার পেছনে বেগম মুজিবের অনেক বড় অবদান ছিল। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল। আমার উপন্যাসের মাধ্যমে বোধ হয় বৃহত্তর পাঠকসমাজের সঙ্গে রেনু নামের এই অপূর্ব চরিত্রটির পরিচয় ঘটবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: পিয়াস মজিদ

No comments

Powered by Blogger.