একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-বাংলা হলো রাষ্ট্রভাষা by আহমদ রফিক

অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে চল্লিশের দশকে ধর্মভিত্তিক ও স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির প্রভাব এত প্রবল হয়ে ওঠে যে বাঙালি মুসলমান ভাষা ও জাতিচেতনা নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায়নি। তারা এখন বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র ভুবনের স্বপ্নে মগ্ন। সে ভুবনে প্রতিযোগিতাহীন আর্থসামাজিক উত্থান। আর্থসামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি।


প্রধানত বাঙালি মুসলমানের এমন এক আবেগের টানে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের এককাট্টা বিজয়ের প্রভাবে এবং আরও একাধিক কারণে ১৯৪৭ আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজন এবং ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের (শুরুতে ডোমিনিয়ন) প্রতিষ্ঠাতা।
যেমন ভারতীয় কংগ্রেসে, তেমনি ভারতীয় মুসলিম লীগ দলের শক্তিশালী কেন্দ্রে ছিল অবাঙালি প্রাধান্য। এ প্রাধান্য বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বাধীনতাত্তোর স্বপ্ন নষ্ট করেছে। যেমন করেছে অখণ্ড বঙ্গদেশে তেমনি বিভাগোত্তর পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে সে ধারা এখনো চলছে। চলছে মূলত ভাষার আগ্রাসনে—হিন্দি ইংরেজি সেখানে আগ্রাসী। বাংলা সেখানে শিক্ষিত শ্রেণীতে তৃতীয় ভাষা।
বাঙালি মুসলমানেরও স্বপ্ন ভাঙে সদ্য গঠিত পাকিস্তানে উর্দুর আগ্রাসনে। তবে শুরুটা ১৯৪৭ সালের প্রথম দিক থেকেই, যখন মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতারা বলতে থাকেন যে হবু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যেমন বলেছিলেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান (১৭ মে, ১৯৪৭)। সাহসে ভর করে এর লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন জনাকয় বাঙালি মুসলমান দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে। সাংবাদিক-লেখক আব্দুল হক তাঁদের অন্যতম।
এভাবে শুরু রাষ্ট্রভাষা উপলক্ষে বাঙালি-অবাঙালির বাদ-প্রতিবাদ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২—এই কালপরিসরে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, আন্দোলন প্রধানত বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে। বায়ান্নর আন্দোলনে মৃত্যু আন্দোলনের চরিত্র বদল ঘটায়। ভাষাচেতনার বিস্তার ঘটে শুধু ছাত্রসমাজেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তান-চেতনার সঙ্গে ভাষাচেতনার দ্বন্দ্ব শুরু। দ্বন্দ্ব ক্রমশ সচেতন রূপ নেয় বাঙালি জাতিসত্তা ও জাতীয়তাকে ঘিরে।
বাঙালি মুসলমান এই প্রথম আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে ভাষা ও ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিসত্তাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। এ দুটো বিষয়ে তাদের সচেতনতা বাড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, সচেতনতা ধর্মীয় চেতনা ঊহ্য রেখে আমাদের এ ভাষিক চেতনার বড় বিষয় ছিল এর সর্বজনীন চরিত্র। তা না হলে সেই ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে নীলক্ষেত ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীদের পক্ষে সম্ভব হতো না সদ্য ছাপা পোস্টকার্ড, ইনভেলাপে বাংলা না থাকার জন্য বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমে আসা। সম্ভব হতো না পরবর্তী সময়ে আরবি হরফে বাংলা চালুর মতো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাই মিলে প্রবল প্রতিবাদ।
এভাবে ১৯৪৭ থেকে আসে ১৯৪৮, এরপর ১৯৫০, অবশেষে ১৯৫২। একের পর এক পাকিস্তান সরকারের বাংলাবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাঙালি সন্তান লড়াই করেছে। যদিও এ লড়াইয়ের ভিত তৈরি করেছে ছাত্রসমাজ, কিন্তু ঘটনাপরম্পরায় তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ, যেমন—শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক বা পেশাজীবী শ্রেণী। যোগ দিয়েছে সাধারণ মানুষ। এ সমর্থন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরদার করেছে।
বিশেষ করে দাবি জোরদার হয়েছে ১৯৫৩ সালের শহীদ দিবসে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রত্যুষে প্রভাতফেরির গম্ভীর আয়োজনে, স্মরণকালের বিশাল মিছিলের শহর পরিক্রমায় এবং বিকেলে আরমানিটোলা ময়দানে অবিশ্বাস্য জনসমাগমে। বলা চলে গণমানুষের জোয়ারি প্রতিবাদে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, সম্মেলনে দাবি উঠেছে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ছাত্র ও শিক্ষিত শ্রেণীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি, বলতে হয় রক্তভেজা একুশে ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার ডাক বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষায়তনগুলোতে পর্যন্ত উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এভাবে ১৯৫৬-এর ফেব্রুয়ারি অবধি চলেছে ‘শহীদ দিবস’ পালন প্রতিবাদে, দাবিতে, স্লোগানে; ব্যতিক্রম ১৯৫৫-এর ফেব্রুয়ারি ইস্কান্দারি শাসনে।
যে জনপ্রতিবাদের চাপে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা প্রত্যাহার করে পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করে ১৯৫৫ সালে, সম্ভবত সেই একই চাপে ১৯৫৬ সালে গৃহীত নয়া সংবিধানের ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রে’ রাষ্ট্রভাষা হয় ‘উর্দু ও বাংলা’। কিন্তু নামকাওয়াস্তে। কারণ শর্ত থাকে যে সরকারি কাজে পরবর্তী ২০ বছর ইংরেজি ব্যবহূত হবে। তবে বাঙালিকে এত দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাহাত্তরে নয়া সংবিধানমাফিক ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।

No comments

Powered by Blogger.