কোপেনহেগেনের মূষিক

পর্বতের মূষিকের চেয়ে কোপেনহেগেনের মূষিক কোনো দিক থেকেই বড় হতে পারেনি। কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলন যত আড়ম্বর ও উচ্চাশা সৃষ্টি করেছিল, শেষ দিনের ঘোষণায় সে আশার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো প্রস্তাব বা কোনো চুক্তি পাওয়া যায়নি শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে।

শিল্পায়নপূর্ব সময়ের চেয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হলেও খসড়ায় নির্দিষ্ট কোনো বিধি আরোপ করা হয়নি। আগামী দশকগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার উল্লেখও তাতে নেই। জলবায়ু বিপর্যয়রোধে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যে হারে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা বলেছেন, তাতে আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয় রাখা হয়নি। ফলে সংশয়ের দোলাচলের মধ্য দিয়ে কোপেনহেগেন সম্মেলনের সমাধি রচিত হয়েছে। কোপেনহেগেনের এ সম্মেলন ঘিরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে আশা-আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল, এক কথায় তা ভেস্তে গেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে টানাটানি, অন্যদিকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ভারত-ব্রাজিল-দ. আফ্রিকার মতো দেশের মতৈক্য না হওয়া। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনায় পরোক্ষ সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। ব্রিটিশ পরিবেশমন্ত্রী এড. মিলিব্যান্ড অভিযোগ করে বলেছেন, একটি আইনি বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তি করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার মাধ্যমে চীন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আলোচনা ‘ছিনতাই’ করেছে। তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে চীনের প্রতিনিধিরা চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও অসম্মতি জানায়। হোয়াইট হাউসের শীর্ষস্থানীয় এক উপদেষ্টা বলেছেন, চীন ও ভারত নিজেদের অঙ্গীকার করা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এখন উন্নত দেশগুলো একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে রেহাই পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য একটি তহবিল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ তহবিল ২০২০ সালে শুরু করে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এ তহবিলের কতভাগ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে তার নিশ্চয়তা তিনি দেননি।
তবে কোপেনহেগেন সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলো দুটি বিষয় স্বীকার করে নিয়েছে— ১. মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণে তাদের নিজেদের দায় এবং ২. বিপর্যয় রোধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। তবে প্রতিশ্রুত অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রাপ্তি নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। সুতরাং জলবায়ু বিপণ্নতার স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের পাতে আপাতত কিছু পড়েনি তা বলাই যায়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের সাফল্য একটিই, আর তা হলো জলবায়ু বিপর্যস্ত দেশগুলোর শীর্ষে নিজেদের অবস্থান। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের যে করুণ পরিণতি হবে, সে কথা সবাইকে বলার সুযোগ পেয়েছি মাত্র। বাংলাদেশের জলবায়ু কূটনীতি এ অর্থে সফল হলেও ক্ষতিপূরণ আদায়ের আসল লড়াই এখনও পড়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনকে সফল হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, সম্মেলনের পর সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। এটাই এ সম্মেলনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সফলতা। কিন্তু তাদের এ দৃষ্টি ‘নেকনজর’ কিনা তা জানতে আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের সব নেতাই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মতো লোক দেখানো হবে না, তার নিশ্চয়তা আমাদের দেবে কে?
দেলাওয়ার জাহান
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.