জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক চুক্তি by জাহাঙ্গীর আলম সরকার

গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য’ দিবস। সারা বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করা হয়। আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমে এসব দিবসে বিশেষ তথ্যসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে লেখা ছাপানো হয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে পরিবেশের বিষয়টি বিচার করলে দেখা যাবে দেশটি পরিবেশসংক্রান্ত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।

যে দেশে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের দৈনিক আয় মাত্র ১ মার্কিন ডলারেরও কম, সে দেশে সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবেশ আশা কঠিন; তবে সরকারকে পরিবেশ বিষয়ে উদাস হলে চলবে না। পরিবেশকে দেখা যায় সামগ্রিক উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী শর্ত হিসেবে। পরিবেশ কেবল গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের হাতে নিরঙ্কুশভাবে ছেড়ে দেয়ার মতো বিষয় নয়। এটা এমন এক বিষয়, যার গভীর নৈকট্য আছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, জীবনবৈচিত্র্য এবং তাদের সত্যিকারের অধিকার, তাদের মানসম্মত প্রশাসনিক ব্যবস্থাদির ভেতরে থাকার আকাঙ্ক্ষা এবং এর সমতা বিধানের সঙ্গে।
বিগত প্রায় দুই দশক সময়কালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অংশগ্রহণে বিশ্ব কার্যক্রম ও বহুপাক্ষিক কার্যকরী পরিবেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার মধ্যে পরিবেশের পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সর্বাধিক দরকারি চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত EARTH SUMMIT ধরিত্রী সম্মেলনে। সব স্বাক্ষরকারী দেশের মতো বাংলাদেশেরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। প্রাথমিক বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বিশদ বিবরণ প্রদান করা হলো। রিও সম্মেলনের বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তিগুলোর একটি মরুকরণ প্রতিকারে জাতিসংঘ কনভেনশনের (UNCCD) লক্ষ্য বিশ্বের সব অঞ্চলে মরুভূমির বিস্তার রোধ করা। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরা-সমস্যা থাকলেও মরুকরণের কোনো সমস্যা নেই। কাজেই এ বহুপাক্ষিক চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওজোন স্তর ক্ষয়কারী পদার্থের বিষয়ে জাতিসংঘ কনভেনশন রিওডি আর্থ সামিটের আগেই সংগঠিত হয় ভিয়েনাতে। এখানে গৃহীত প্রটোকল মন্ট্রিয়েলে চূড়ান্ত করা হয় বলে একে ‘মন্ট্রিয়েল প্রটোকল’ বলা হয়। এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থ (ODS : Ozone Depleting Substances) উত্পাদন ও ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাংলাদেশ প্রথমে ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থ ব্যবহার বন্ধে পরিকল্পনা তৈরি ও পরে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ প্রতিশ্রতি রক্ষায় যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশে ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থ আমদানি (উত্পন্ন হয় না) ও ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমানো হয়েছে (মূলত ওজোন স্বাক্ষরকারী পদার্থ যুক্ত রাসায়নিক দিয়ে অ্যারোসল জাতীয় স্প্রে ব্যবহার)। পরিবেশ দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
জীববৈচিত্র্য কনভেনশন ও রামসার কনভেনশন
রিওডি বহুপাক্ষিক চুক্তির অন্তর্গত জাতিসংঘ জীববৈচিত্র্য কনভেনশন (UNCBD : United Nations Convention on Biodiversity) বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদেশে জীববৈচিত্র্যসহ ব্যাপক এলাকা রয়েছে। জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের আগেই জলাভূমি সংক্রান্ত রামসার কনভেনশন হয়। এটাও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশে বিশ্ব পর্যায়ে গুরুত্ববাহী জলাভূমি আছে। বাংলাদেশ এ চুক্তিগুলোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। সুন্দরবনের একটি অংশকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ (ঞযব ডড়ত্ষফ ঐবত্রঃধমব) ঘোষণা করা এবং জলাভূমি রক্ষায় আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। অবশ্য এর পরও দেশে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি এবং জলাভূমি বিপন্ন হওয়া অব্যাহত রয়েছে। এখনও অনেক কিছু করতে হবে। বর্তমানে সরকার জীববৈচিত্র্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে, যাতে ভবিষ্যত্ কর্মপন্থা নির্ধারিত হবে। রিও সম্মেলনে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘ পরিবেশ পরিবর্তন রূপরেখা কনভেনশন’ (UNFCCC : United Nations Framework convention on Climate Change) বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বিশ্বপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশ নিরিক্ষীয় অঞ্চলের নিম্নভূমি দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশ এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় সক্রিয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও দুর্যোগ সম্পর্কে এর মধ্যেই বেশকিছু মূল্যায়ন সমাপ্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচি (NPA : National Adaptation Programmed of Action) তৈরি করছে। এ বিষয়ে ইউএনসিসিসির স্বল্পোন্নত দেশের তহবিল দেখে সহযোগিতা পাওয়া গেছে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে জাপানের কিয়োটো শহরে ইউএনএফসিসিসির তৃতীয় সিডিপি সম্মেলনে কিয়োটো প্রটোকল প্রবর্তন হয়। এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর জন্য গ্রিন হাউস নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের ওপর গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের সীমা আরোপ করা হয়নি। তবুও উন্নত দেশগুলোর সহায়তায় ‘পরিচ্ছন্ন উন্নয়ন পন্থা’ (CMD)-কার্যক্রমে বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো হবে এবং সেজন্য বাংলাদেশকে সুবিধা দেয়া হবে। এতে গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোয় দেশে বিনিয়োগ হবে। দেশে এখনও কোনো (ঈগউ)-প্রকল্প চালু হয়নি। অবশ্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে। ইউএনএফসিসির অংশীদার সম্মেলন সিডিপি প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আরও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারে। বিশেষত স্বপ্নোন্নত দেশের দলে বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় হতে হবে। এ ছাড়াও দেশে স্থানীয় ও জাতীয় স্তরে জলবায়ু পরিবর্তনে সম্ভাব্য কুফল মোকাবিলার পন্থা নির্ধারণ ও পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এতে দেশের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় নিম্নভূমি এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, যেমন দরিদ্র চাষী ও জেলেদের বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। এ বিষয়ে সৌভাগ্যক্রমে দেশে যথেষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক-সম্পদ আছে। CMD প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যও বাংলাদেশকে উদ্যোগী হতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য শিথিল চুক্তি আলোচিত বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তিগুলো স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক পালনীয়। এ ছাড়াও পরিবেশ-সম্পর্কিত আরও কিছু শিথিল আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে, যাতে বাংলাদেশও একটি পক্ষ।
কর্মসূচি ২১ : রিওতে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিটে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশসহ দেশগুলো নিজ নিজ দেশে স্বেচ্ছামূলক ভিত্তিতে জাতীয় পরিবেশ পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বা এজেন্ড-২১ কার্যকর করবে। বিভিন্ন দেশ তাদের পরিকল্পনাকে বিভিন্ন নাম দিয়েছে। বাংলাদেশ ৯০-দশকে সুশীল সমাজের ব্যাপক সহযোগিতার মাধ্যমে ‘জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনা’ নেমাপ (NEMAP : National Environmental Management Action Plan) নামে এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। নেমাপ আন্তর্জাতিক মহলে সবচেয়ে কার্যকর ও অংশীদারী পরিকল্পনা হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। পরবর্তীকালে সরকার সুশীল সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে ‘টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি’ বা সেম্প প্রকল্পের মাধ্যমে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। জোহান্সবার্গ কর্মসূচি : আর্থ-সামিটের দশমবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০২ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গ শহরে ‘টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন’ (WSSD : World Summit on Sustainable Development) অনুষ্ঠিত হয়। এখানে অনেক পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। বরং এখানে ‘জোহান্সবার্গ কর্মসূচি’ নামে একটি স্বেচ্ছামূলক সমঝোতা হয়েছে। এর মাধ্যমে অংশীদার দেশগুলো পানি, পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুত্ ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেবে এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে এগুলোকে যুক্ত করবে। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে শীর্ষ সম্মেলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা : ২০০০ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে নিউইয়র্কে ‘মিলেনিয়াম শীর্ষ সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ২০১৫ সাল মেয়াদে ৮টি মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। এর ৭টি-দারিদ্র্য বিমোচন, পানি ও পয়ঃ স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন-লক্ষ্য এবং অষ্টমটি পরিবেশ সম্পর্কিত। তাতে প্রতিটি দেশসহ বাংলাদেশ পরিবেশ-বিপর্যয় রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশ-বিষয়কে যুক্ত করবে।
বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলে এ পর্যন্ত বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তিকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা দেখা গেছে। প্রতিটি চুক্তির জন্য পৃথক সচিবালয়গুলোর মধ্যে তেমন যোগাযোগ নেই। এর ফলে কোনো দেশেই সব বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তিকে সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন প্রচেষ্টার মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা যায়নি। বাংলাদেশের মতো কোনো দেশে যে কোনো পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়কে উন্নয়নের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনোই অবকাশ নেই। কাজেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের উচিত বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তিগুলোকে তাদের নিজ দেশে সম্পৃক্ত করা। বাংলাদেশে ভবিষ্যতের করণীয় হলো গুরুত্বপূর্ণ বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তিগুলোকে নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিত করা, জাতীয় পর্যায়ে সব পক্ষের সহযোগে করণীয় সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা এবং জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় সে সব পদক্ষেপকে সম্পৃক্ত করা। যদি সেটা করা সম্ভব হয় তবে জাতীয় পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য দিবস পালন করার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

No comments

Powered by Blogger.