কিডনি রোগ-নগরে শুচিতা ও স্বাস্থ্য সমস্যা by তৃপ্তি বালা

আমাদের সমস্যা অনেক, সমাধানের সুযোগ অনেক। মানসিকতার ঘাটতিও যে অনেক, সে কারণে কাঙ্ক্ষিত একটা অবস্থায় যাওয়া অনেক সময়ই সুদূরপরাহত মনে হয়। কষ্ট হয়, ভাবতে খারাপ লাগে, একজন মানুষের জীবনে নিজের চাওয়া-পাওয়া, মৌলিক দাবি-দাওয়া-অধিকারগুলোর ন্যূনতম একটি অবস্থা অর্জিত হবে না। মানুষ হিসেবে বাঁচার, সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা, একটা ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখানোর সুযোগ-সমন্বয়-দৃষ্টান্ত কোনো কিছুই নিজের সীমার মধ্যে নেই।


নাগরিক সুবিধার মধ্যে নেই এবং সে রকম উদেযাগও নেই। কষ্ট বোধ হয় কিন্তু আপাতত মনে হয় তার চেয়েও বড় যা দরকার জীবনটাকে টিকিয়ে রাখা। মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে থাকতে চাইলে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা এবং মানুষ তো চাইবে না যে মানুষের মতো মান-সম্মান নিয়ে বাঁচতে অন্তর্গত বোধ-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু খেয়েদেয়ে বাথরুম-টয়লেট করে প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই যে কৃতার্থ মানব, সে তো নয়।
মানুষের জীবন যখন, চাইব মানুষের মতোই বাঁচতে, মৌলিক চাওয়া-পাওয়াগুলোর সমন্বয় ঘটাতে এবং আপাতত রাষ্ট্রীয় একজন নাগরিক হিসেবে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার পেতে।
মনুষ্য হিসেবে মানবিক অধিকারের কথা দূরে সরিয়ে রেখে আপাতত জীবনের জন্য মৌলিক ওই যে খেয়েদেয়ে পয়োনিষ্কাশনের বিষয়টা, তাতেই গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। পয়োনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নাগরিক সভ্যতার একেবারেই মূলের বিষয়। আপাতত এর একটা বিহিত চাই। নগরে, শহরে, অফিসে-আদালতে পরিচ্ছন্ন সুষ্ঠু পয়োনিষ্কাশনের পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট দরকার।
কিডনি মানব শরীরের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনির কার্যকারিতার অনেকখানিই নির্ভর করে আমাদের অভ্যাস, চর্চা, পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নিয়মানুবর্তিতার ওপর। মানব শরীরের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি দেহগত জটিল পরিপাক-বিপাক ক্রিয়া শেষে উদ্ভূত বর্জ্যনিষ্কাশনে অনিবার্য এক ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে, যার অবর্তমানে রক্তের সুস্থ স্বাভাবিক স্থিতাবস্থা বজায় থাকা তথা বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়। অতি আবশ্যক এই অঙ্গটি বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণত কিছু নিয়মকানুন স্বাস্থ্যবিধির মাধ্যমে অনায়াসেই কর্মক্ষম থাকতে পারে। মূত্রাশয়, মূত্রথলি, মূত্রনালি তথা গোটা মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ রোধ অতি জরুরি একটি বিষয়। প্রচুর পরিমাণে পানি পান, তাজা শাকসবজি, ফলমূলের পাশাপাশি মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ এড়িয়ে চলা সুস্থ কিডনি কার্যকারিতার একটি অনিবার্য দিক। আমাদের এই দেশে অফিস-আদালত থেকে শুরু করে ঘাটে-পথে, ট্রেনে, বাসস্ট্যান্ডে সাধারণের ব্যবহারের টয়লেট-পায়খানার অবস্থা এমনই সর্বহারা নাকাল গোছের যে বাড়ির বাইরে যারপরনাই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। টয়লেট-প্রস্রাব-পায়খানার অব্যবস্থা-দুরবস্থার কথা ভেবে মানুষজন বিশেষ করে, মেয়ে এবং মায়েরা তাদের ভেতরকার চাপ ভেতরেই চেপে রাখেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তা কমাতে পানিও কমিয়ে পান করেন। প্রস্রাব চেপে থাকা মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণের অন্যতম কারণ। নোংরা টয়লেট ব্যবহারও তার জন্য কম দায়ী নয়। আর পুনঃপুন এ রকম মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ কিডনির ওপর গিয়েও আঘাত করে এবং একসময় তার কার্যকারিতা নষ্টও করে দেয়। প্রতিবছরই আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, বাড়ছে কিডনি অকার্যকর মানুষের সংখ্যা। যার পরিণতি, চিকিৎসা কিংবা ফলাফল সবই অত্যন্ত ব্যয়বহুল কিংবা অসম্ভবই। সে কারণেই মনে হয় বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি, জীবনযাপনের মৌলিক, আনুষঙ্গিক সহজসাধ্য, অনায়াসলব্ধ নিয়ম, পরিচ্ছন্ন আচরণ—এসবই দীর্ঘ মেয়াদে ভালো থাকার অন্যতম শর্ত। সরকারি, বেসরকারি তত্ত্বাবধানে সাধারণ, সাধারণ নয় সব মানুষজনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বাথরুম-টয়লেট (গণশৌচাগার) নির্মাণ করা প্রয়োজন।
অফিস-আদালত থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, বাস, রেলস্টেশন, গ্রামগঞ্জে পর্যাপ্তসংখ্যক পাবলিক টয়লেট যেমন দরকার, তার পরিচ্ছন্ন রক্ষণাবেক্ষণ ও সুস্থ-সভ্য মানবজীবন নিশ্চিত করা অন্যতম শর্ত।
তৃপ্তি বালা: গল্পকার, চিকিৎসক।

No comments

Powered by Blogger.