ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর-সূচিত হোক ভাষা-চেতনার নবযাত্রা

বছর ঘুরে আবার এলো বাঙালির ভাষা আন্দোলনের স্মারক ফেব্রুয়ারি মাস। ১৯৫২ সালে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে এ মাসে রক্ত দিয়েছিলেন ভাষা শহীদরা। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই রক্তদান বৃথা যায়নি, পরাধীন দেশে অর্জিত হয়েছিল ভাষার অধিকার। আর এ আন্দোলনের প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছিল কালান্তরে।


জাতির ইতিহাসের পরবর্তী কালপর্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল ভাষা আন্দোলন, ইতিহাসের গতিমুখকে নতুন দিকে চালিত করেছিল। ভাষা-চেতনা এ অঞ্চলে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল তা ক্রমে স্বাধিকার আন্দোলনের উত্থান ঘটিয়েছিল, মূর্ত করে তুলেছিল স্বাধীনতার দাবিকে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভাষা আন্দোলনের চেতনার নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্রমশ ভাষা-চেতনা নবপত্রে পল্লবিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে পুরো মাসটিই ভাষা আন্দোলনের স্মারকে রূপান্তরিত হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ফুলে ফুলে ভরে ওঠা শহীদ মিনারগুলো যেমন ভাষা শহীদদের প্রতি শোক, শ্রদ্ধা প্রকাশের মুখ্য আয়োজন, তেমনি আছে পুরো মাসব্যাপী স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে মহিমান্বিত সেই আন্দোলনকে স্মরণের নানা অনুষ্ঠান। পাশাপাশি এ মাস জ্ঞান ও বিদ্যার উৎসব বইমেলারও। বই ও ভাষা আন্দোলনের ওতপ্রোত সংযোগের কারণে বাংলা একাডেমী আয়োজিত মাসব্যাপী বইমেলার নাম অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সকলেই স্বীকার করেন, বইমেলাকে কেন্দ্র করে এ সময় লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের সম্মিলন ঘটে তা অনন্য। প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠকরা এ মেলার মাধ্যমেই নতুন বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। বই নিয়ে দীর্ঘতর ও বৃহত্তর এ মেলবন্ধন আমাদের সংস্কৃতির গৌরব। বরাবরের মতো এ বছরও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই বইমেলা শুরু হচ্ছে। চলবে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত। ইতিমধ্যে মেলার স্টলগুলো সেজে উঠেছে বাহারি আয়োজনে। বই প্রকাশের ব্যস্ততায় সরব হয়ে উঠেছে বইপাড়ার রাতদিন। আশা করা হচ্ছে, তিন থেকে চার হাজার বই প্রকাশিত হবে এবারের মেলায়। জমজমাট বিক্রির প্রত্যাশা করছেন প্রকাশকরা। বইমেলার সাফল্য নিয়ে সংশয় নেই, কিন্তু নতুন প্রজন্মগুলো বইয়ের জগৎ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কি-না এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের দিকে আমাদের অগ্রযাত্রা কতটা সংহত ও লক্ষ্যভেদী তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আমরা মনে করি, জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ গড়তে হলে প্রজন্মগুলোকে বইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ক্ষুদ্র পাঠক সমাজের গণ্ডিকে প্রসারিত করতে হবে। লেখা, বই প্রকাশ ও বিপণনে সরকারকে অধিকতর দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কী তা বিচার করার সময় এখন এসেছে। কেননা এ বছর ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তি হবে। গত বছর আমরা পালন করেছি স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পূর্তির উৎসব। চার দশকে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতটা সফল হয়েছে তা নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা হয়েছে বছরজুড়ে। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছরে আমাদের দেখতে হবে, জ্ঞান-বিদ্যা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার দিগন্তে আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতা কতটুকু। ভাষার মানচিত্রে কী আমরা পেতে পারতাম আর কী পেয়েছি তাও পরখ করে দেখতে হবে। ফেব্রুয়ারি যেমন শোকের তেমনি উৎসবের। যেমন উৎসবের তেমনি ভাবনারও। সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার জন্য নিবেদিত এ মাসে বাঙালির মহৎ উদ্যোগগুলো সাফল্য পাক। জ্ঞান ও বিদ্যার চেতনা ছড়িয়ে যাক সমাজে। ভাষা আন্দোলন আমাদের ভবিষ্যৎ যাত্রার পাথেয় হোক। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তিতে ভাষা শহীদ ও ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.