আওয়ামী লীগ তাদের ক্রসফায়ারের ঐতিহ্য রক্ষা করছে by বদরুদ্দীন উমর

র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে লেখালেখি, বিবৃতি, সভা, মিছিল ইত্যাদি অনেক হলেও এই ক্রসফায়ার বন্ধের কোনো আশু সম্ভাবনা যে নেই এটা এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য থেকে সুষ্ঠুভাবেই বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, তারাও ক্রসফায়ারের বিরোধী এবং ক্রসফায়ার এখন হচ্ছে না। আসল কথা হলো, পুলিশ আক্রান্ত হলে তারা আত্মরক্ষার জন্য গুলি করছে এবং তাতেই আক্রমণকারীদের মৃত্যু হচ্ছে।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, আক্রমণকারীদের গুলিতে কোনো র্যাব অথবা পুলিশ সদস্য নিহত হচ্ছে না। নিহত হচ্ছে শুধু আক্রমণকারী! কোনো কোনো সময় এই নিহত আক্রমণকারীদের মৃতদেহ হাতকড়া পরা অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে!! হাতকড়া পরা কোনো লোক কীভাবে আক্রমণকারী হতে পারে এর কোনো ব্যাখ্যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা তাদের র্যাব ও পুলিশের বক্তব্যে নেই।
ক্রসফায়ারে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়নি এ মর্মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য প্রদান করলেও, র্যাবের মহাপরিচালক নিজেদের হেড কোয়ার্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, এ বছরে অর্থাত্ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে (ডেইলি স্টার : ৩০.১২.০৯)। সব মৃত্যুই আইন রক্ষা করে হয়েছে এবং অস্ত্রের কোনো অপব্যবহার হয়নি, একথা বললেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো তার পক্ষে একথা বলা সম্ভব হয়নি যে, র্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে কারও মৃত্যু ঘটেনি।
কিন্তু শুধু র্যাবই ক্রসফায়ার করে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে না। পুলিশ, আনসার ইত্যাদি রাষ্ট্রের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর হাতেও ক্রসফায়ারে প্রধানত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা হলেও সেই সঙ্গে কিছু কিছু ক্রিমিনাল এবং অন্য ধরনের লোকও নিহত হচ্ছে। ক্রিমিনালরা ক্রসফায়ারে নিহত হচ্ছে একথা বলে কোনো মতেই ক্রসফায়ারকে যুক্তিযুক্ত এবং আইনসঙ্গত বলা চলে না। কারণ যে কোনো ধরনের অপরাধীর বিচার ও শাস্তির জন্য দেশে আইন-আদালত আছে। কাজেই কে প্রকৃত অপরাধী এটা বিচারের ভার র্যাব, পুলিশের ওপর আইনত ন্যস্ত নেই। র্যাবের মহাপরিচালক বলেছেন, তারা সব ক্রসফায়ারই আইন অনুযায়ী করেছেন। এটা এক হাস্যকর কথা। এর অর্থ দেশের আইন-আদালত নিয়ে তামাশা করা। আইন-আদালতকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। এভাবে নিজেদের হত্যাকাণ্ড ব্যাখ্যা করা কোনো সভ্য দেশেই সম্ভব নয়। কিন্তু এটা যে সম্ভব শুধু তাই নয়, বাস্তবত হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই তা দেখা যায়। ফ্যাসিস্ট কথাবার্তার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে র্যাব ও পুলিশের মতো সশস্ত্র বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের থেকে অনেক এগিয়ে আছেন এতে সন্দেহ নেই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের এক বিবৃতিতে বলেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যখন ওই বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো বক্তব্যকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন তা ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই অন্যায় কাজে ইন্ধন জোগায়। এ বক্তব্যের মধ্যে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকলেও যেভাবে এটা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ভুল ব্যাখ্যার কারণে ভ্রান্তির সম্ভাবনা যথেষ্ট। বলা হয়েছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো বক্তব্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে ইন্ধন জোগায়। আসলে ইন্ধন জোগানোর প্রশ্ন এখানে অবান্তর। এভাবে বিষয়টি উপস্থিত করে ক্রসফায়ারের স্থল, এমনকি সার্বিক দায়িত্ব র্যাব ও পুলিশের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং এমনভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যাতে মনে হয় যে, রাষ্ট্র ও সরকারি নীতির বাইরে দাঁড়িয়ে এসব সশস্ত্র বাহিনী এ হত্যাকাণ্ড করছে। সরকার এখানে শুধু ইন্ধনদাতা মাত্র!
আইন-সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ার বিরোধিতার জন্য তাদের প্রশংসা করা যেতে পারে, কিন্তু যেভাবে তারা এর চরিত্র ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে সরকারকে শুধু ‘ইন্ধনদাতা’ হিসেবে উপস্থিত করেছেন সে বক্তব্যকে পুরোপুরি নাকচ করা দরকার। কারণ এই ক্রসফায়ারের জন্য সরকারই দায়ী। সরকারি নীতির কাঠামোর মধ্যেই জনগণের বিভিন্ন অংশের ওপর নানা নির্যাতনের মতো ক্রসফায়ারও হচ্ছে। কাজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন র্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ারকে অস্বীকার করে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, তখন তার ভূমিকা ইন্ধনদাতার মতো একেবারেই নয়। এ ভূমিকা সরকারি মুখপাত্র হিসেবে সরকারি নীতিকে সমর্থন করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, র্যাব-পুলিশ ইত্যাদি থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো সংস্থাই স্বাধীন নয়। এগুলো সবই রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং রাষ্ট্রের ম্যানেজার হিসেবে সরকারই নিজেদের নীতির কাঠামোর মধ্যে পরিচালনা করে। কাজেই যেসব কাজ র্যাব-পুলিশ ইত্যাদি করে সেগুলো সরকারি নীতি ও নির্দেশ অনুযায়ীই তারা করে থাকে। এই বাস্তবতার আলোকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক র্যাব-পুলিশের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থনের বিষয়টি বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে, এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ইন্ধন যোগাচ্ছেন না, তাদের সরকারের নির্দেশে যে ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার প্রতি ষোলআনা সমর্থনই তিনি প্রদান করছেন।
এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার তা হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সরকারের কোনো পর্যায়েরই নীতি-নির্ধারক নন। শুধু তিনি কেন, তার মতো কোনো মন্ত্রীরই নীতি-নির্ধারণের ক্ষমতা নেই অথবা ক্ষমতা আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তিনিই সব নীতি-নির্ধারণ করছেন রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে। অন্য সবাই তার হুকুম তামিল করছেন মাত্র। কাজেই প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করে বা রেয়াত দিয়ে শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করলে র্যাব ও পুলিশ কর্তৃক ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে অনেক ফাঁকফোকর থাকে। সঠিকভাবে বক্তব্য প্রদান ও প্রতিবাদ জানাতে হলে এসব ফাঁকফোকর বন্ধ রেখেই সেটা করা দরকার।
১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের সদ্য গঠিত শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিস্ট চরিত্র উন্মোচিত হয়েছিল। দ্রুত এই চরিত্রের বিকাশ ঘটে তা খুব স্পষ্ট হয়েছিল ১৯৭৪-এর ২৮ ডিসেম্বর শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ দেশে যে ফ্যাসিবাদী শাসন একেবারে খোলাখুলিভাবে শুরু করে তাতে তাদের নিজেদের দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারি পত্রিকা ছাড়া সব সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র বন্ধ করা হয়, সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে বাকশাল নামে একটি পার্টি গঠন করা হয়। সেই চরম ফ্যাসিস্ট পার্টির শাসনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত জারি ছিল।
বর্তমানে যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তারা তাদের সেই পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তার ধারাবাহিকতা এরা রক্ষা করছে। শুধু তারাই নয়, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে শাসকশ্রেণী গঠিত হয়েছিল ও শাসন নীতি-নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৭৫-এর পরবর্তী প্রত্যেকটি সরকারই থেকেছে সেই ফ্যাসিস্ট শাসন ও নীতিরই অনুবর্তী। এদিক দিয়ে বলা চলে যে, বস্তুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসকশ্রেণীর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব যেভাবেই দেখা যাক, পরস্পরের সঙ্গে শ্রেণীগতভাবে তারা নাড়ির বন্ধনে আবদ্ধ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ এখন এই অভিন্ন শাসকশ্রেণী ও রাষ্ট্রের ম্যানেজার হিসেবেই শাসন নীতি-নির্ধারণ করছে ও দেশ শাসন করছে।
একথা ভোলার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের উদ্বোধন হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। তারা ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি আটক অবস্থায় সিরাজ শিকদারকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছিলেন। এই ফ্যাসিস্ট হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিব জাতীয় সংসদে সদম্ভে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার’। এসব ঘটনা ঐতিহাসিক। আওয়ামী লীগ ও তাদের বুদ্ধিজীবী চামচারা একথা অস্বীকার করার যতই চেষ্টা করুন তখনকার দিনে তাদের নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকাতেই এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে নিয়ে অন্যান্য গদিনশীন ব্যক্তি ও তাদের বুদ্ধিজীবী সমর্থকরা শেখ মুজিবের সৃষ্ট ঐতিহ্যই রক্ষা করছেন।
এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণকে এখন দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ বর্তমান সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি শুধু ক্রসফায়ারের মাধ্যমেই কার্যকর হচ্ছে না, জনগণের কণ্ঠ রোধ করার জন্য এরা সভা-সমিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে সভা-সমিতির জন্য, মাইক ব্যবহারের জন্য যেখানে কোনো অনুমতির প্রয়োজন হতো না, এখন সেখানে এসবের জন্যই অনুমতির প্রয়োজন হয়। সভা-সমিতি-মিছিলের ওপর প্রায়ই সরকারি পুলিশের হামলা হয়। সাংবাদিকদের ওপর ও সংবাদপত্রের ওপর হামলা হয়। জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্রই প্রকৃতপক্ষে নেই যেখানে সরকারের ফ্যাসিস্টসুলভ নিয়ন্ত্রণ ও হামলা নেই।
এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা দরকার, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এমনই অবস্থা যে, এদের নিজেদের দলের মধ্যেও কোনো গণতন্ত্র নেই, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই এদের শীর্ষতম নেতৃত্ব দলের মধ্যে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র এবং দলের বাইরে দেশের জনগণের ওপর ফ্যাসিবাদ কায়েম করে এখন দেশের শাসন কাজ পরিচালনা করছে।
র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ার, হত্যাকাণ্ড এবং সরকারের পক্ষে তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাইকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই সরকারের সর্বাত্মক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.