এক কথা by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

দুটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথাবার্তা—কিছুটা বাক-বিতণ্ডাও চলছে। বিষয় দুটি হলো, ক্রসফায়ার এবং আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা রাজখোয়াকে গ্রেফতার ও ভারতের কাছে হস্তান্তর। বিষয় দুটি নিয়ে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়া খুব স্পষ্ট উক্তি করেছেন।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু একবারের জন্যও তার দৃঢ় অবস্থান থেকে বিচ্যুত্ হননি। ‘ক্রসফায়ার’ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটিও ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। আমি তার এ বক্তব্যকে স্বাগত জানাই এবং সমর্থন করি। তিনি চরম সত্যটাই প্রকাশ করেছেন। কারণ, ক্রসফায়ারে মৃত্যু বলতে বোঝায়, সশস্ত্র দুটি পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে কারও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটা। আমরা এর আগে শুনেছি, কোনো ‘দুষ্কৃতকারী’কে গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে ‘অস্ত্র উদ্ধারে’ গেলে, তার দলের সশস্ত্র লোকেরা তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য গুলিবর্ষণ শুরু করলে তার জবাবে আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরাও আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করে। আর মাঝে পড়ে পালাতে গিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যু ঘটে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির। কিন্তু আমাদের দৃঢ়চিত্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমন কিছু ঘটার কথা অস্বীকার করেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ দিন-তারিখ উল্লেখসহ ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’র হাতে গত নভেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত যে ১৩২ জন নাগরিকের নিহত হওয়ার হিসাব দিয়েছে, সেগুলো তাহলে কী? অধিকার অবশ্য বলেছে, ‘তাদের আটকের পর বিচারের মুখোমুখি করা ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।’ (আমার দেশ, ১০ ডিসেম্বর, পৃষ্ঠা-১ ও ১৩)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ক্রসফায়ার নয়, তো সাফ কথা, ক্রসফায়ার নয়। আমি তার দৃঢ়তায় মুগ্ধ। এখন আপনারা এগুলোকে হত্যাকাণ্ড, না কি বলে ধরবেন, তা আপনাদের ব্যাপার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো গত ২৬ ডিসেম্বর আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই। ১৭ নভেম্বর ২০০৯ ভোরে মাদারীপুরে পাওয়া নিহত দুই ভাই লুত্ফর খালাশী ও খায়রুল খালাশী মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা আগে গ্রেফতার হয়েছিল এবং ‘ক্রসফায়ারে’ তাদের মেরে ফেলা হতে পারে, এ আশঙ্কায় ১৬ নভেম্বর তাদের পরিবার-পরিজন সংবাদ সম্মেলন করেছিল। উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলও জারি করেন। রুল জারির দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে কোনো ক্রসফায়ার হয়নি।’ অতএব আদালত ওই দুই ভাইয়ের নিহত হওয়ার ঘটনাকে কী হিসেবে গণ্য করেছেন—করছেন বা করবেন তা আদালতের বিচার্য বিষয়।
এবার রাজখোয়ার প্রসঙ্গ। গত ৪ ডিসেম্বর ২০০৯, বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় খব প্রকাশিত হয় যে উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ‘উলফা’র (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াকে বাংলাদেশে গ্রেফতার করে ভারতের বিএসএফের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তারা অবশ্য এ খবরের সূত্র হিসেবে ভারতের বিভিন্ন প্রচার ও প্রকাশ মাধ্যম এবং বিবিসির নাম উল্লেখ করেন। ভারতের কোনো কোনো কর্তৃপক্ষের নামও আসে সূত্র হিসেবে। কিন্তু আমাদের দৃঢ়চিত্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪ ডিসেম্বর স্পষ্ট করে জানান, রাজখোয়াকে বাংলাদেশে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়নি—এমনকি ভারত সীমান্তে পুশব্যাকও করা হয়নি।
অতঃপর রাজখোয়া গৌহাটি আদালত প্রাঙ্গণে যখন তার বাংলাদেশে আটকের কথা স্বীকার করেন এবং সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখনও ‘এক কথার মানুষ’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়া তার কথায় অবিচল থাকেন, এতে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে আমার চেয়েও তিনি অনেক ভালো করে জানেন, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতোই মিথ্যাচারে পারদর্শী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই মিথ্যাবাদীদের বিরুদ্ধে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সরকারের সব মন্ত্রীই যদি তেমনটি করেন, তবে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব—নিজস্ব সম্পদ-নিজস্ব অধিকার রক্ষা—সব বিষয়েই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারে। আমরা সবাই জানি, ভারত সর্বতোভাবেই বাংলাদেশকে ছোট করা, বঞ্চিত করা, সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা চালিয়ে থাকে। যেহেতু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্বাস করি, তাই রাজখোয়ার বিষয়ে ভারতের মিথ্যাচারও তেমনই একটি প্রচেষ্টা বলে মানতেই হচ্ছে। এমনিতেই ভারতকে আমরা চুক্তিভঙ্গকারী বলে জানি। গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে এমনই প্রতারণা করেছে ভারত যে—পাকিস্তান আমলে যেখানে রাজশাহীর শহররক্ষা বাঁধে এসে আছড়ে পড়ত পদ্মার ঢেউ, সেখানে এখন পদ্মার ক্ষীণ ধারা দেখতে হলে পাড়ি দিতে হয় চার কিলোমিটার মরুভূমি। বিশ্বখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ্ সেতু পয়েন্টে এখন ধু-ধু বালুচর। এসব কথা বললেই, ভারতবিরোধী রাজনীতি করে বন্ধুত্ব নষ্টের অপবাদ কাঁধে এসে পড়ে। একটু এগিয়ে কেউ কেউ আবার সাম্প্রদায়িক বলেও আঙুল তোলে। অবশ্য, ভারতীয় চশমায় যারা চোখ মুড়ে রেখেছেন তাদের কাছে ধু-ধু বালুতে থৈ থৈ পানি বলে মনে হতে পারে। ‘দুর্জনের ছলের অভাব হয় না’ সিরাজুদ্দৌলাহ নাটকের এ সংলাপটি ভারতের সঙ্গে যে কোনো সম্পর্ক স্থাপন বা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে মনে না রাখাটা ভীষণ বোকামি। ভারতের যে কোনো দাবির বিপক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ার মতো অটল থাকা অতি আবশ্যক। বর্তমানে ভারত বায়না ধরেছে, তাদের দূতাবাস রক্ষার জন্য তাদের কমান্ডো বাহিনী আনার। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা হওয়ার পরও ব্রিটেনের দূতাবাস রক্ষায় ব্রিটিশ বাহিনী আনার প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশি নিরাপত্তাকর্মীরাই ব্রিটিশ দূতাবাসের নিরাপত্তা রক্ষা করে চলেছেন। তাহলে ভারতের এ আবদার কেন? ‘শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর!’ এখনই তার চক্রান্ত বুঝতে না পারলে বিপদ আছে। যদি কোনোক্রমে বাংলাদেশ সরকারকে চশমা পরিয়ে করিডোর আদায় করতে পারে ভারত—তাহলে দু’দিন পরে সেই করিডোর নিরাপদ করার অজুহাতে চাইবে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন করতে। অতএব আবারও বলছি, ভারতীয় সব দাবি এবং প্রচার-প্রচারণার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ার মতোই অটল হয়ে দাঁড়াতে হবে। দেশের জনগণ তো সঙ্গে থাকবেই।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.