স্বাস্থ্যসেবা-‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ নিয়ে কিছু কথা by এ বি এম আবদুল্লাহ

গত ২ নভেম্বরে প্রথম আলোয় নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ধনী দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ও তার চিকি ৎসা-ব্যয় সম্পর্কে লেখক তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও ধনী দেশ। স্বাস্থ্যসেবায় তাদের মান শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু জনগণকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই তাদের নেই।


হুমায়ূন আহমেদের লেখাতেই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, ওই দেশে নো ফ্রি লাঞ্চের মতোই নো ফ্রি চিকি ৎসা। ওই দেশের নাগরিকদের নিজেদের আয়ের এক বিরাট অংশ ব্যয় করতে হয় স্বাস্থ্যবিমা করার জন্য। আর যাদের স্বাস্থ্যবিমা নেই, তাদের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে চিকি ৎসার ব্যয় বহন করা স্বপ্ন মাত্র। যাদের স্বাস্থ্যবিমা করা আছে, অসুখ-বিসুখ হলে তাদের চিকি ৎসা দেওয়ার পর খরচটা সেই বিমা থেকে কেটে নেওয়া হয়। যার বিমা নেই, সে চিকি ৎসা নিতে গেলে নগদ অর্থ দিয়ে সেবা নিতে হয় এবং তা পরিশোধ করতে হয় সেবা পাওয়ার আগেই। জনাব হুমায়ূন আহমেদের লেখায় আরেকটি জিনিস ফুটে উঠেছে, কখনো জরুরি রোগী হাসপাতালে চিকি ৎসা নিতে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় না, চিকি ৎসা অবশ্যই দিতে হবে। তবে চিকি ৎসা শেষে বিরাট অঙ্কের অর্থটুকু কোনোক্রমেই মওকুফ করা হয় না। ওই রোগী অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে বলতে হবে, সে কপর্দকশূন্য। পাওনা অর্থ তাকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে, এককালীন না দিতে পারলে ভেঙে ভেঙে, এমনকি মাসে মাসে ৫ ডলার হলেও দিতে হবে, প্রয়োজনে সারা জীবন দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কোনো ছাড় নেই।
আমাদের দেশের নাগরিকসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ যারা ওই দেশে অবৈধভাবে বসবাস করে বা যাদের স্বাস্থ্যবীমা নেই, তাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন। নেহাত জরুরি বা জটিল কোনো রোগব্যাধি না হলে তারা ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, চিকি ৎসকের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য বা সাহস তাদের নেই। জরুরি প্রয়োজনে চিকি ৎসা নেওয়ার পর নিজেকে কপর্দকশূন্য ঘোষণা করতে হয় এবং ধীরে ধীরে চিকি ৎসার খরচটুকু ভেঙে ভেঙে হলেও পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে, তা যত কষ্টেরই হোক।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল গরিব দেশে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় কোথাও চিকি ৎসাসেবা না দিয়েই টাকা দাবি করা হয় না। চিকি ৎসা পেয়েও যেখানে অনেকেই চিকি ৎসার খরচটুকু দিতে চান না, হাসপাতালের ভাড়া কমানোর জন্য নানা বাহানা করেন। চিকি ৎসা শুরুর আগেই যদি আমেরিকার মতো পুরো টাকা আগেই জমা দিতে বলা হয়, ‘তা না হলে চিকি ৎসা হবে না’ তাহলে এর ফল কী দাঁড়াবে? শুরু হবে কর্তৃপক্ষকে গালাগাল দেওয়া এবং চিকি ৎসককে ‘কসাই’, ‘অমানুষ’, ‘অমানবিক’ ইত্যাদি বলে গালি দেওয়া অথবা শুরু হবে ক্লিনিক বা হাসপাতাল ভাঙচুর করা, কর্মচারীদের সঙ্গে হাতাহাতি, মারামারি, তাঁদের গালাগাল ইত্যাদি।
আমাদের দেশে সম্পদের অভাব আছে, সেবার মানও স্বাভাবিকভাবেই সর্বোত্তম নয়। কিন্তু নীতিগতভাবে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার স্বীকৃত এবং তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তাই সরকারিভাবে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে খরচ একেবারেই কম। নিঃস্ব হতদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চিকি ৎসা অবশ্যই চলছে বিনা মূল্যেই। এত সস্তা চিকি ৎসাসেবা বর্তমান বিশ্বের অনেক উন্নত ধনী দেশেও নেই।
আমাদের বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকি ৎসার খরচ সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশি হলেও অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো দরিদ্র রোগীদের কম মূল্যে সেবা দিয়ে থাকে। দরিদ্র রোগীদের জন্য আলাদা ফান্ড থাকে, যেখান থেকে তাদের অনেক ব্যয়বহুল চিকি ৎসাই অল্প মূল্যে করে দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজস্ব পুঁজি এবং বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা। তাই সব চিকি ৎসা বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে পাওয়া যাবে, এটা আশা করা যায় না।
আমাদের মনোভাব এমন হয়ে গেছে, চিকি ৎসা হলো মানবসেবা এবং তা বিনা পয়সায় হবে। আমাদের মানসিকতা এভাবেই তৈরি। বছরের পর বছর ধরে হ্রাসকৃত মূল্যে বা বিনা মূল্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ফলে চিকি ৎসার জন্য ব্যয় করা দরকার, এই ভাবনাটাই আমাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা থেকে শুরু করে সিনেমা দেখা বা বেড়াতে যাওয়ার মতো বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে আমরা অকাতরে ব্যয় করে থাকি। অন্য যে কোনো পেশা বা সেবা যেমন-পরিবহন বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে টাকা দিতে হবে, এটা সবাই জানেন এবং সেভাবেই প্রস্তুত হয়ে থাকেন। কিন্তু চিকি ৎসার জন্য কেউ আলাদাভাবে কিছু বরাদ্দ রাখেন না। তাই চিকি ৎসার পর যখন অর্থ দেয়ার প্রশ্ন ওঠে, তখন অনেকেই তা দিতে প্রস্তুত থাকেন না। শুরু হয় অসন্তোষ।
শেষ করার আগে হুমায়ূন আহমেদকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যে তিনি দেশে ফিরে আমাদের দেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্যানসার হাসপাতাল গড়ে তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এই সদিচ্ছা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। আমাদের দেশে বিত্তবান মানুষের অভাব নেই। তারাও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারেন এবং কেটারিং হতে পারেন। যাঁর যে অবস্থান আছে, সেখান থেকেই কাজের চিহ্ন রেখে যাওয়াই হলো মানুষ হিসেবে আমাদের বিধাতা প্রদত্ত দায়িত্ব। স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, ‘হে মানব, যেখানে যাবি তোর পদচিহ্ন রেখে যা’।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ: ডিন, মেডিসিন অনুষদ; অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.