আগুপিছু ঘড়ির কাঁটাঃ এটাই শেষ তামাশা হোক

ঘড়ির কাঁটা আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার সরকারি সিদ্ধান্তে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে এদেশের মানুষ। মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে আনা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অবশ্য আগামী ৩১ মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটা আবার এক ঘণ্টা করে এগিয়ে থাকবে।

এভাবে বছরের ৭ মাস এবং ৫ মাস স্থানীয় সময়ে এক ঘণ্টা হেরফের হবে। বিদ্যুত্ সাশ্রয়ের কথা বলে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন এক ঘণ্টা এগিয়ে আনা হয় তখন সবাই বলেছিল, বেহুদা বিড়ম্বনা ডেকে আনা ছাড়া এতে অন্য কোনো উপকার হবে না। কিন্তু নতুন কিছু করে চমক সৃষ্টির নেশায় আচ্ছন্ন মহাজোট সরকার কারও কথায় কর্ণপাত করেনি। বরং মন্ত্রী ও কর্মকর্তা মিলিয়ে ওপর মহলের কেউ কেউ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আনার ‘সাফল্য’ সম্পর্কে উদ্ভট সব কথাবার্তা বলতে থাকেন। এমনকি দু’একজন রীতিমত হিসাব কষে এই কাণ্ডের ফলে কতদিনে কত মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সাশ্রয় হয়েছে, সে সম্পর্কে ‘প্রকৃত তথ্য’ হাজির করে ফেলেন। তাদের উত্সাহ এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, সরকার ৩১ অক্টোবর মাঝ রাত থেকে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হতে সরে আসে। এদিকে শীত এসে গেছে। দিন ছোট হয়েছে আগের তুলনায়। ফলে নতুন সময় অনুযায়ী সাড়ে ৭টার স্কুল ধরার জন্য ছাত্রছাত্রী আর অভিভাকরা যখন দৌড় শুরু করেন চারদিকে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ নিয়ে সবাই ক্ষুব্ধ। ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে মিডিয়ায়। শেষ পর্যন্ত নীতি নির্ধারকদের কানে যে পানি ঢুকেছে, তারা যে ঘড়ির কাঁটা আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিচ্ছেন, সে কারণে গোটা জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, মাঝের এই বিড়ম্বনা পোহানো কি একান্তই জরুরি ছিল? বিদ্যুত্ ঘাটতি অবশ্যই আমাদের এক বড় সমস্যা। কিন্তু জাতির ঘাড়ে তুঘলকি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এই অতিসরল বিষয়টি যাদের মাথায় ঢোকে না তারা যখন দিন বদলের ডাক দেন, তখন হাসি সংবরণ করা দায় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৩৮ বছর হয়ে গেল। আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় স্বাধীন জাতি হিসেবে যাত্রা শুরু করে এশিয়া মহাদেশেরই বহু দেশ আজ আমাদের পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাদের এই অগ্রগতি দূরদর্শী নীতি নির্ধারণ, নিরলস পরিশ্রম এবং কঠোর শৃঙ্খলার মাধ্যমে সফল ব্যবস্থাপনার ফল। এর বিপরীতে আমরা বছরের পর বছর শুধু ‘ক্রান্তিকাল’ অতিক্রম করে চলেছি। ঘড়ির কাঁটা নিয়ে টানাটানি চলতে থাকলে এই ‘ক্রান্তিকাল’ অনন্তকালেও শেষ হবে না।
ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে আনার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পর কেউ কেউ আবার এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু করেন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, আন্তর্জাতিক রেওয়াজ, ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টায় না পিছিয়ে রাত দুটোয় পেছানো ভালো, বছরের শেষ দিনে কেন এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, এসব পণ্ডিতি কথাবার্তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। সাধারণ মানুষের কাছে সময়ের বর্তমান হিসাব এক চরম অস্বাভাবিকতা। ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে আমজনতা মনে করছে একটা ভুলের সংশোধন হিসেবে। তাই ঘড়ির কাঁটা নিয়ে এটাই যেন জাতির সঙ্গে শেষ তামাশা হয়—এ ছাড়া আর কিছু আমাদের কাম্য নয়।

No comments

Powered by Blogger.