যে আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল গণতন্ত্র by মনজুর আহমদ

পত্রিকার পাতায় ছবি দেখে শিউরে উঠলাম। দাউ দাউ করে জ্বলছে দৈনিক ‘আমার দেশ’-এর একটি কপি। সেই জ্বলন্ত কাগজটি হাতে নিয়ে উল্লাস করছে কয়েকজন তরুণ। ক্ষোভ নয়, ক্রোধের প্রকাশ নয়, ছবি দেখে মনে হলো পত্রিকা পোড়ানোর মহাআনন্দে তারা মাতোয়ারা। বাংলাদেশে এ দৃশ্য নতুন নয়।

পরমত বিশেষ করে বিরোধী মতে অসহিষ্ণু মহল এর আগেও এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, মাঝে মাঝেই ঘটিয়ে থাকে। তবে কোনো বেসরকারি মহল বা গ্রুুপের এমন কোনো কার্যকলাপ জনমনে তেমন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন সরকারি মহল এ তত্পরতায় লিপ্ত হয়। তাদের এ কার্যক্রম অভিহিত হয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ হিসেবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা হিসেবে। সংবাদপত্র দলননীতির পরিণতি যে এমনটাই হয় সে অভিজ্ঞতা তো আমাদের সামনে জ্বাজল্যমান রয়েছে।
পত্রিকার পাতায় ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম। আর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আরেকটি আগুনের দৃশ্য। সে দৃশ্য সাম্প্রতিক সময়ের নয়।
সে দৃশ্য ১৯৭৩ সালের। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য বড় কথা ছিল না। তিনি তখন ছিলেন একক ক্ষমতাধর। সারাদেশ ছিল তার হাতের মুঠোয়। সারাদেশের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তার একক কর্তৃত্ব।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই একক ক্ষমতাই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার চারপাশে ভিড় করে থাকা দলীয় লোকজনের জয়ধ্বনির বাইরে দূর দিয়ে যে নিন্দাবাদ দানা বেঁধে উঠছিল তাকে তিনি হিসাবে নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’—স্লোগানে তখন থেকেই তিনি গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে শুরু করেছিলেন। এক দেশের এক নেতা অর্থাত্ তিনি ছাড়া আর কোনো নেতা এ দেশে থাকবে না। কোনো নেতা না থাকার অর্থ আর কোনো দল থাকবে না এ দেশে। দল থাকলেই তো নেতার সৃষ্টি হবে। যত দল ততই তো নেতা। আবার এই এক আওয়াজে তার নিজের দল আওয়ামী লীগেও অন্য কোনো নেতার নেতৃত্ব বা প্রভাবকে নস্যাত্ করে দেয়ার প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মেধাবী নেতা তাজউদ্দিন আহমদের নাম।
‘এক নেতা এক দেশ’-এর আওয়াজ যতই জোরদার হচ্ছিল, ততই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর হয়ে উঠছিল। রক্ষীবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে নিধন করা হচ্ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। জীবনের অনিশ্চয়তায় সন্ত্রস্ত গ্রামগঞ্জের মানুষের ওপর নেমে এসেছিল ত্রাসের রাজত্ব। পাশাপাশি আওয়ামীপন্থীদের মহোত্সব চলছিল সম্পদ, বাড়িঘর, রিলিফ সামগ্রী লুটপাটের। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি মহান কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে এসে, এত রক্তপাত, এত আত্মত্যাগের পরও মানুষ সবকিছু ভুলে সব নীতি, আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করে লুটপাটের মতো বর্বর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আওয়ামীপন্থীরা। তাই আজ যখন তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা উচ্চারিত হতে শুনি তখন তাকে বড় বেশি মেকি মনে হয়।
সে সময়েই হামলা চালানো হয়েছিল বিরোধী রাজনীতির ওপর। বিরোধীদের সমালোচনায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাসীন মহল। রাজনীতির জবাবে রাজনীতি নয়, তারা জবাব দিয়েছিল পেশিশক্তির প্রয়োগে। তারা হামলা চালিয়েছিল সাময়িকভাবে সরকারের বিরোধিতাকারী ন্যাপ (মোজাফফর) অফিসে। হামলা চালিয়েছিল জাসদ অফিসে। আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল এ দুটি অফিস।
তোপখানা রোডে জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত দিকে অবস্থিত ন্যাপ অফিসে আগুনে আটকে পড়েছিলেন সেদিনের ন্যাপ নেত্রী, আজকের আওয়ামী লীগ মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। কোনো মতে উদ্ধার পেয়েছিলেন তিনি। এ ঘটনা ১৯৭৩-এর জানুয়ারির। এ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৭৪-এর ১৭ মার্চ জাসদ কার্যালয়ে। আগুন দেয়া হয়েছিল বিরোধী রাজনীতিতে। কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল সব ধরনের প্রতিপক্ষের। এভাবেই এগিয়ে নেয়া হয়েছিল ‘এক নেতা এক দেশ’ তত্ত্ব বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্ব সম্পন্ন হলো ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে, সব দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করে ‘এক নেতা’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে।
তিয়াত্তরের জানুয়ারিতে বিরোধী রাজনীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাতের জন্য নির্যাতন-নিপীড়নের যে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, ইতিহাস সাক্ষী, সেই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল বাংলার মানুষের অনেক সংগ্রামে অর্জিত গণতন্ত্র।
পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার দেশ’-এ অগ্নিসংযোগের ছবি দেখছিলাম। আতঙ্কিত হচ্ছিলাম, আবার কী তবে শুরু হলো? ভাবছিলাম, এর শেষ কোথায়?
নিউইয়র্ক, ২৬ ডিসেম্বর, ’০৯

No comments

Powered by Blogger.