শেষ প্রশ্ন by শেখ রোকন

অনেকে নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যায় বাংলাদেশ বিষয়ক দুটি প্রতিবেদন রয়েছে। একটি সম্প্রতি ব্যর্থ হয়ে যাওয়া সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে। কেবল বিষয় নয়, ওই অভ্যুত্থান অপচেষ্টার অন্যতম কুশীলব ইশরাক আহমেদের মন্তব্য থাকার কারণেও ওই প্রতিবেদন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর স্পর্শকাতরতার কাছে হেরে যাওয়া অপর প্রতিবেদনটির বিষয় 'গ্রামীণের ব্যবসা সাম্রাজ্য' (গ্রামিন'স বিজনেস এম্পায়ার)।


ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য ইকোনমিস্টের বিষয় হয়ে ওঠা আর নতুন কী? শান্তিতে নোবেল পাওয়া অন্য অনেকের সঙ্গে আমাদের এই অর্থনীতিবিদের ভেদরেখা স্পষ্ট। নোবেল শান্তি পুরস্কার তার মুকুটে আরেকটি সোনালি পালক যুক্ত করেছে বটে, আরও কারও কারও মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতির জন্য তাকে সেটা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। 'গরীবের ব্যাংক' গ্রামীণের প্রতিষ্ঠাই তাকে দেশ-বিদেশে এক নামে পরিচিত করেছিল। খোদ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকতে পারে; কিন্তু তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান যে ক্ষুদ্রঋণের বৈশ্বিক মডেলে পরিণত হয়েছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এতটাই যে, তার নোবেলপ্রাপ্তিও অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং প্রতিবার নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়ই তার নাম আগাম আলোচিত হতো। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে প্রত্যাশা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। দেশের ভেতর ও বাইরের সংবাদমাধ্যম ছেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশি এ অর্থনীতিবিদের আলোকচিত্র ও বিবরণীতে। চার বছর পর ফের তিনি সংবাদ শিরোনামে পরিণত হতে থাকেন, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে তার থাকা না-থাকা নিয়ে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০১১ সালের মে মাসে তাকে 'অবসর' নিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিতর্ক যে থেমে নেই, ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন তার প্রথম প্রমাণ নয়।
এ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি রাজনৈতিক। সরকার কেন মুহাম্মদ ইউনূসকে অবসর প্রদানে উদ্যোগী হলো। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য তার নিজের 'রাজনৈতিক' অবদান কতখানি? দ্বিতীয় প্রশ্ন আইনি। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাকে এভাবে অবসর দেওয়া যায় কি-না? তিনি কি 'সরকারী কর্মকর্তা'? গ্রামীণ 'ব্যাংক' হলেও আর দশটা সরকারি ব্যাংকের নিয়ম-কানুন এর জন্য প্রযোজ্য কি-না?
ইকোনমিস্ট সামনে নিয়ে এসেছে তৃতীয় প্রশ্ন। গ্রামীণ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আরও যে ৪৮টি ব্যবসায়িক, আধা-ব্যবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে, সেগুলোর কী হবে? টেক্সটাইল থেকে মোবাইল ফোন, খাবার পানি থেকে সফটওয়্যার_ নানা খাতের এসব উদ্যোগের মূল্যও কম নয়। ইকোনমিস্টের হিসাবে ১৬০ কোটি ডলার। এর কোনো কোনোটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে টেলিনর, ড্যানোন, ভোয়েলিয়ার মতো বহুজাতিক সব কোম্পানি। কোনো কোনোটির অংশীদারিত্ব ৯৯.৫ শতাংশও রয়েছে। সরকার বলছে, গ্রামীণ ব্যাংক যেহেতু এসব উদ্যোগের সম্পূর্ণ বা আংশিক মালিক, সেসবের মালিকও এখন সরকার। ড. ইউনূসের পক্ষে বলা হচ্ছে, এসব উদ্যোগ স্বতন্ত্র, একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক নেই। ফলে সরকার কেবল ব্যাংকের মালিকানা দাবি করতে পারে। এসবের বিদেশি অংশীদাররা অবশ্য বিতর্কের বদলে ব্যবসাতেই মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছে। ইকোনমিস্টের প্রশ্নের জবাবে টেলিনরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের সম্পর্ক পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা ও গ্রামীণ ফোনের সুস্বার্থে অব্যাহত থাকবে।
ভালো কথা, সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকার ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক ও আইনি লড়াইয়ে এসব উদ্যোগের সুস্বাস্থ্য শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকবে তো? শেষ প্রশ্ন ও উদ্বেগ সেটাই। কারণ এত বড় বড় উদ্যোগে ভাটা পড়লে দিনের শেষে ক্ষতি বাংলাদেশেরই।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.