গহন গহীন-ক্রীড়াঙ্গনে কিসের এই কালো ছায়া! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

সফলতা-বুভুক্ষু বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গন আকারে-প্রকারে ছোট হলেও মাঝেমধ্যে চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দিয়ে শুধু দেশবাসী নয়, ক্রীড়ামোদী বিশ্ববাসীরও নজর কাড়ে। বর্তমান সময়ে, অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগে তথ্য-মহাসড়ক দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরটিও অজানা থাকে না। এসব নতুন কোনো তথ্য নয়। সময় যত যাবে, বিশ্ব তথ্য-প্রগতির পথে আরো এগিয়ে যাবে।


খেলাধুলার ক্ষেত্রে একসময় ফুটবলের ছিল অমিত সম্ভাবনা। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের ফুটবলাররা করাচি উপকূলবাসী শক্তিশালী মাকরানি খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি ক্ষিপ্রতা ও নৈপুণ্য দেখিয়ে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ আজ, ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (ফিফা) ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেটিং তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৭। ধারণা করা যায়, সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হতাশাজনক ফলাফলের জের ধরে পরবর্তী রেটিংয়ে (যা খুব দ্রুতই প্রকাশিত হওয়ার কথা) বাংলাদেশের অবস্থানে অবনতি হতে পারে, এমন আশঙ্কা ওয়াকিবহাল মহলের।
ফুটবলের সেই দিন নেই। হয়তো সেই দুঃখেই পুরনো দিনের মাঠকাঁপানো খেলোয়াড়রা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সোনালি অতীত নামে ফুটবল দল গঠন করেছেন! মাঝেমধ্যে নিজেরা বন্ধুত্বমূলক ফুটবল খেলায় যখন এসব খেলোয়াড় মাঠে নামেন, তাদের বিস্মৃতপ্রায় খেলোয়াড়ি নিপুণতার কিঞ্চিৎ পরিচয় পেয়ে এ যুগের দর্শকরা মোহিত হন। দীর্ঘশ্বাস মোচন করে ভাবেন, কোথায় গেল ফুটবলের সেই সুবর্ণ সময়।
শুটিংয়ের ছিল প্রচুর সম্ভাবনা। কমনওয়েলথ গেইমসের অন্যতম স্বর্ণপদকজয়ী আসিফের ক্যারিয়ারে আকস্মিক অমানিশা নেমে এলো মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনায়। সামাজিক অবস্থানজনিত আভিজাত্যের কারণে পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িচালকের এলোপাতাড়ি প্রহারে, নিজেকে নিরাপদ ভাবতেন যেই স্থানে, সেই রাইফেলস ক্লাবেই গুরুতর আহত হলেন আসিফ। এত বড় ঘটনার পর আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে কিছুতেই আর আত্মবিশ্বাস তাঁর ফিরে পাওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আসিফের পারফরম্যান্সই তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীকালে।
একদা হকি খেলায় উপমহাদেশের দুটি দল ভারত ও পাকিস্তানের ছিল একচেটিয়া প্রাধান্য। স্টিক ওয়ার্ক আর শারীরিক নিপুণতার কারণে হকি যখন ছিল ছন্দময় খেলা, তখন এই দুই দলের খেলায় সৃষ্টি হতো জ্যামিতিক নকশা! বাংলাদেশেও এই খেলার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কোচ, ট্রেইনার এনে চেষ্টা কম করা হয়নি। কিন্তু সবই মনে হয় বিফলে গেছে। খেলার জগতে হকি এখন শুধুই একটি নাম। মাঝেমধ্যে খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ, হকি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ দেশবাসী শোনেন।
ফুটবলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে মাঠবিমুখ ফুটবল দর্শককে আবার স্টেডিয়ামমুখী করার জন্য ফুটবল ফেডারেশন কম চেষ্টা করছে না। এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন, ফিফার আর্থিক ও বৈষয়িক সহায়তা এই বাবদে কম পাওয়া যায় না। কিন্তু ফুটবল ফেডারেশনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং আর কর্তৃত্বের লড়াইয়ের খবর ওপেন সিক্রেট। আর একটি সমস্যা, যা মাঝেমধ্যেই প্রকট আকার ধারণ করে, তার নাম আমি দিয়েছি 'কোচ জিনক্স্'! যখনই কোনো প্রতিযোগিতায় দল খারাপ করে, তখন খৰটির কোপ প্রথম পড়ে বেচারা কোচের ওপর! অগৌরবজনক পথে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়। যেন কোচ মাঠে নিজে খেলে দলকে ডুবিয়েছেন। এ দেশে কোচরা আসেন গলায় মালা পরে উষ্ণ অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে। বিদায় নেন নীরব অশ্রুর উষ্ণ স্রোত গণ্ডদেশে প্রবহমান নিয়ে! কী ফুটবল, কী ক্রিকেট-কোচ সম্পর্কিত দৃশ্যপট প্রায় একই রকম! একই দৃশ্য পাকিস্তানের ক্রিকেটেও দেখা যায়।
এ দেশ ভ্রমণে এসে মুগ্ধ পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেছিলেন, বঙ্গাল মুলুকের প্রবেশদ্বার অনেক। কিন্তু বের হওয়ার পথ নেই একটিও। অনুরূপ না হলেও প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ-দ্বার সম্পর্কে বিদেশি কোচরা যদি তাঁদের কান-লব্ধ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, প্রবেশপথ তো দেখলাম, নিষ্ক্রমণের পথটাও জেনে রাখা ভালো, তাহলে বলব, তিনি দোষণীয় কিছু বলছেন না, বরং অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ জ্ঞানগর্ভ উপলব্ধি রয়েছে তাঁর।
ক্রীড়াঙ্গনের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। যদিও বিশ্বের মাত্র কয়েকটি দেশে এই খেলা অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) পূর্ণাঙ্গ সদস্য। ২০০০ সালে ভারতের বিরুদ্ধে ঢাকায় দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ম্যাচটি বাংলাদেশ খেলে ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ তারিখে পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপের ম্যাচে। এর আগে অবশ্য বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে খেলে। তবে সহযোগী সদস্য দেশ হিসেবে ছিল এই অংশগ্রহণ।
আইসিসির পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে বিগত এক দশকাধিককালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে একটি বাক্যই ব্যবহার্য। দলটি সাফল্য-ব্যর্থতায় পৌনঃপুনিকভাবে ধারাবাহিকতার অভাব দেখিয়ে চলেছে। না দলটি একটানা সফল, না ব্যর্থ। পাটিগণিতের তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কের গোলকধাঁধার মতো এর দশকব্যাপী পারফরম্যান্সের খতিয়ান।
ক্রিকেট খেলার মানোন্নয়ন, খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে। খেলোয়াড়রা নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, এক ম্যাচে ব্যর্থতা আর পরের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি এসব নতুন কিছু নয়। খেলোয়াড়রা কিছুটা নাম করলে কী যে মনস্তাত্তি্বক সমস্যা তাঁদের পেয়ে বসে, তা বলা মুশকিল। মিডিয়ার সামনে কথা বলার সময় একটু প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের আত্মম্ভরিতা চমকিত করার মতোই।
তাঁরা ভুলে যান, জাতির কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা আছে। দর্শকরা আছেন বলেই তাঁরা মাঠে নামেন খেলতে।
ইদানীং ক্রিকেটে নতুন এক উপদ্রব যোগ হয়েছে, যার নাম মনি কাঞ্চন। এই উপদ্রব আমদানি করেছে বোর্ড ফর ক্রিকেট কন্ট্রোল ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। পাঠক, ক্রিকেট বোর্ডের নামের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ শব্দটি ক্রিকেট প্রশাসকদের মনমানসিকতার পরিচায়ক।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ নামে ধুমধড়াক্কা টি ২০ ক্রিকেট আসর ভারতে আয়োজন করা হয় ক্রিকেট নামক খেলাটিকে জনপ্রিয় করার মহৎ উদ্দেশ্যে। লোলিত মোদি নামের এক করিৎকর্মা ব্যক্তি আইপিএল আয়োজন করে রীতিমতো এক 'আইকনে' পরিণত হলেন। খেলোয়াড়দের মধ্যে টাকার হরিলুট শুরু হয়ে গেল। নিলামে খেলোয়াড়ের দাম হাঁকেন ফ্রাঞ্চাইজিরা। দাম হাঁকেন ফিল্ম জগতের নামিদামি 'হস্তীরা'। চিত্রজগতের সুন্দরী তারকারা মাঠে বসে থাকেন স্পেশাল বক্স। ক্যামেরা সময়মতো ক্লোজআপে দেখায় তাঁদের। চিয়ার গার্লস দলের মাঠে স্বল্পবসনা উপস্থিতি খেলোয়াড় না দর্শকদের চিত্তচাঞ্চল্যের জন্য, তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি আজও।
বেহিসেবি খরচ যেখানে, নয়ছয় সেখানে অবশ্যম্ভাবী। ললিত মোদি অভিযুক্ত হলেন দুর্নীতির দায়ে। আর নতুন প্রশাসন নতুন উদ্যমে আইপিএলের আসর চালু রাখল।
খেললেই টাকা। সুতরাং আইকন জাতীয় খেলোয়াড়রাও আইপিএলের খেলায় মাঠে নামেন জখম লুকিয়ে। নাম বলার দরকার নেই, এই খেলোয়াড়রা দেশের পক্ষে খেলতে গেলে পায়ের সামান্য ফোস্কাকেও বিরাট ইনজুরি বলে দল থেকে সরে দাঁড়ান।
ক্রিকেটের শুদ্ধতায় যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা ক্রিকেটের এই সর্বনাশা রূপ দেখে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হন। সর্বনাশা ফলও দেখা গেছে। ভারতের মতো শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের দল ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত মুখ থুবড়ে পড়ছে। অথচ ক্রিকেটে সবচেয়ে ধ্রুপদী রূপটির নাম টেস্ট ক্রিকেট।
শঙ্কিত ক্রিকেট প্রশাসকরা। না, তাঁদের শঙ্কার কারণ টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের হার নয়। বরং এই হারের ফলে সামনের আইপিএলের আসরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকরা। মাঠে দর্শক সমাগম কমে যাওয়ার ভয়।
দর্শকদের মাঠমুখী করার জন্য অ-ক্রিকেটীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন তাঁরা। ভাবছেন অক্রিকেটীয় কিছু আইকন_যেমন দৌড়বিদ উসেইন বোল্ট, ব্রিটিশ ফর্মুলা ওয়ান রেসিং কার ড্রাইভার লুহ হ্যামিল্টন আর হ্যারি পটার সিনেমার কিশোর-নায়ক ড্যানিয়েল র‌্যাডক্লিফকে মাঠে মধ্যবিরতিতে উপস্থিত করার কথা। আরো নানা রকম চিন্তায় এখন অস্থির তাঁরা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক। এডমন্ড, ওকলাহোমা, যুক্তরাষ্ট্র

No comments

Powered by Blogger.