এখন মৌসুম মামলার! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

শীতকালে আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ধুম আয়োজন হতো। বাইরে প্যান্ডেল টাঙিয়ে সার্কাস, কৃষি প্রদর্শনী, যাত্রা আর মাসব্যাপী শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন হতো। মাসব্যাপী প্রদর্শনীতে থাকত রকমারি জিনিসপত্রের সমাহার। ছোটবেলায় এসব প্রদর্শনীতে যেতাম বড়দের হাত ধরে। এক কোনায় থাকত সার্কাসের ব্যবস্থা।

মরণ কূপ নামক খেলায় মোটরসাইকেল কখনও বা বাইসাইকেল আরোহীকে কাঠের বেড়ায় আড়াআড়িভাবে তার বাইক চালাতে দেখে শিহরিত হয়ে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করতাম ভয়ে। কাঠের তক্তার সামনে দাঁড়ানো লোকের পাশে শট্ শট্ করে তীক্ষষ্ট ছোরা ছুড়ে মারতেন ওস্তাদ নামের চৌকস খেলোয়াড়টি। ছোরার সামনে দাঁড়ানো সাহসী লোকটিকে মনে হতো অন্য জগতের কেউ। আমাদের শৈশবের নায়িকা ছিলেন ট্র্যাপেজে কসরত্ দেখানো কিশোরী, যে শূন্যে লাফ দিয়ে এক রিং থেকে অন্য রিংয়ে চলে যেত উড়ন্ত পাখির মতো!
এখন এসব খেলার কমতি দেখি সমাজে। যাত্রার প্যান্ডেল যদি পড়ে কোনো গ্রামে, নিশ্চিন্তে যে থাকবেন যাত্রার মানুষ, তেমন নয়। একদল সুবিধাভোগীকে নিয়মিত টোল দিতে হয়। অশ্লীলতার অভিযোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রতিনিয়ত।
এসব কর্মকাণ্ড কম হলেও হালে আরেক ধরনের কর্মকাণ্ডের খবর এক-দু’দিন পরপর শোনা যাচ্ছে।
এখন চারদিকে চলছে মানহানির মামলার ছড়াছড়ি। মানহানির মামলায় শুধু টাকায় নয়, ডলারেও ক্ষতিপূরণ দাবি করা হচ্ছে! মান হরণের খেসারত টাকায় চেয়ে সন্তুষ্ট থাকছেন না কোনো কোনো বাদী। ডলারেও দাবি করছেন। বিশ্বায়নের এই যুগে ডলারের প্রচলন বিশ্বব্যাপী। এ কারণেই শুধু যে ডলারের দাবি, তা নয়। যে অভিযোগে মানহানির মামলা হচ্ছে, সেই অভিযোগের মূলেও কিন্তু ডলার!
মামলায় বিবাদী পক্ষকে মামলার হিসাব রাখার জন্য রীতিমত নথিরক্ষক নিয়োগ দিতে হবে ধারণা করি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যদি একই পক্ষের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা হতে থাকে তাহলে এ ছাড়া উপায় কী? কোনো কোনো মামলায় আবার অভিযুক্ত পক্ষকে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশও থাকছে। নির্দেশনামা জারি করা হচ্ছে দেশের এ প্রান্তে ও প্রান্তে।
পত্রিকার এক রিপোর্টের এমন বিস্ফোরক ক্ষমতা! ইদানীং আমি অকালপ্রয়াত রাষ্ট্রদূত এম রুহুল আমিনের গল্পে গ্রিক ট্র্যাজেডি-সমগ্র নামক একটি বই পাঠে নিমগ্ন রয়েছি।
এ বইটির উল্লেখ এ লেখায় কেন করলাম তা ভেবে যারা আমার শাপান্ত করছেন, তাদের বলি—আড়াই হাজার বছর আগে লেখা গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলো যে আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি তার কারণ অন্যেরা কেমন দেখবেন, জানি না। তবে আমি দেখছি প্রধানত দু’টি উক্তির কারণে।
ট্রয়ের হেলেনের সৌন্দর্যে বিমোহিত প্যারিস প্রেমিক হিসেবে উত্তম, সন্দেহ নেই। হেলেনের সৌন্দর্য তুলনা রহিত। হেলেনের কারণে ট্রয়ের যুদ্ধ বেঁধেছিল আর সেই যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হয়েছিল ট্রয় নগরী। প্রাণ দিয়েছিল দু’পক্ষের অগনিত যোদ্ধা। ভালোবাসার মানুষের জন্য আত্মবিধ্বংসী পদক্ষেপ নিয়েছিল প্যারিস। আর জন্ম হলো সেই বিখ্যাত উক্তির : ‘হেলেন, দি ফেস দ্যাট লঞ্চড আ থাউজেন্ড শিপ’—যে মুখাবয়বের জন্য হাজার জাহাজ জলে ভেসেছিল। এর অনুকরণে কি বলা যায় না, দি নিউজ দ্যাট লঞ্চড আ থাউজেন্ড সুটস—যে সংবাদের জন্য হাজার মামলা দায়ের হলো?
ইস্কিলাইসের প্রমেথিউস বাউন্ড—শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসের একটি সংলাপ কি যুগে যুগে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা পায় না?
অগ্নিদেব হিফাস্টাস পর্বতশৃঙ্গে শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসকে দেখে যারপরনাই ব্যথিত হন। পাহাড়ের চূড়ায় নির্যাতিত হতে থাকবেন প্রমিথিউস। বিশ্রামহীন নিদ্রাহীন হবে তার দিন-রাত। দেব রোষের কারণে এ থেকে তার মুক্তি নেই। এবং হিফাস্টাসের সব কথার এক কথা ‘নব্য ক্ষমতার প্রকাশ তো সব সময় অতি প্রকটই হয়ে থাকে!’
কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ইস্কিলাইসের!
আড়াই হাজার বছর ধরে, তার রচনার প্রথম প্রকাশের পরে, পৃথিবী যুগে যুগে দেখেছে ক্ষমতার প্রকাশ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.