চরাচর-সিরাজকান্দির ঐতিহাসিক জাহাজমারা যুদ্ধ by শফিউদ্দিন তালুকদার

১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুরের নিকরাইল ইউনিয়নের মাটিকাটার দক্ষিণ-পশ্চিমে যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ে সিরাজকান্দি ঘাট নামক স্থানে। যে ঘটনার মাধ্যমে সারা দেশ, এমনকি সারা বিশ্বের মানুষ সেদিন অবাক বিস্ময়ে জেনেছে ভূঞাপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় কাহিনী।


মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কম্পানি কমান্ডার মেজর হাবিবের নেতৃত্বে সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই জাহাজ দখল, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার শেষে মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক জাহাজে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাকে 'সিরাজকান্দির জাহাজমারা যুদ্ধ' নামে অভিহিত করা হয়। সিরাজকান্দির জাহাজমারা যুদ্ধকে 'মাটিকাটার জাহাজমারা যুদ্ধ' নামেও অভিহিত করা হয়। জায়গাটি সিরাজকান্দি 'জাহাজমারা ঘাট' নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের চিরতরে ধ্বংস করার জন্য উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রংপুর সীমান্ত অঞ্চলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়।
১১ আগস্ট ১৯৭১ সাল। দুপুরবেলা। মাথার ওপর প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ। জাহাজবহর আস্তে আস্তে যমুনা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে উত্তর দিকে এগিয়ে চলছিল। ছোট আকারের দুটি এবং বড় আকারের একটি জাহাজ নির্বিঘ্নে চলে গেল। মেজর হাবিব কিছু বললেন না। বহরের দ্বিতীয় জাহাজটি ধীরে ধীরে নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে যেতেই একযোগে গর্জে ওঠে মেজর হাবিব ও তাঁর সহযোদ্ধাদের হাতের অস্ত্র। পাকিস্তানি সেনারাও স্কর্টবোট থেকে বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় পেছনে পড়া জাহাজ দুটি উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যায়। সামনের জাহাজ দুটিও সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। আক্রান্ত জাহাজটি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে পাঁচ-ছয় শ গজ দূরে বালুর ডুবোচরে আটকে যায়। জাহাজ আটকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন খানসেনা ছোট ছোট গানবোটে দ্রুত সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। জাহাজ থেকে হানাদারদের কোনো গুলি আসছে না। ইতিমধ্যে দুজন নাবিক জাহাজের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভাটি থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। তাঁদের একজন জাহাজের সারেং গোলাম মোস্তফা। সারেংয়ের কাছে থেকে মেজর হাবিব জেনে নেন, জাহাজে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে। অতঃপর মেজর হাবিবের নির্দেশে জাহাজের সারেং গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ জিয়াউল হক, মোতাহের আলী মিঞা ও সামাদ গামা ছোট একটি নৌকাযোগে জাহাজে ওঠেন। জাহাজের নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ছিল হালকা, ভারী অস্ত্র এবং গোলাবারুদে ভর্তি। জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট অর্ডারের হিসাব অনুযায়ী এক লাখ ২০ হাজার বাঙ্ েপ্রায় ২১ কোটি টাকার নানা ধরনের চায়নিজ, ব্রিটিশ ও মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ছিল। জাহাজগুলো পরিচালনার নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ প্রাণে বেঁচে গেলেও সহকারী কমান্ডার আতাউল্লাহ ও সুবেদার রহিম খান মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে মারা যায়। মাটিকাটার যুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলাসহ স্থল ও জলপথে ভূঞাপুর ঘিরে ফেলে। টাঙ্গাইল থেকে এলেঙ্গা হয়ে সরাসরি ভূঞাপুরের দিকে, ঘাটাইল-গোপালপুর-হেমনগর হয়ে ভূঞাপুরের দিকে, কালিহাতী থেকে সরাসরি ভূঞাপুরের দিকে, সিরাজগঞ্জ থেকে ১৫-২০টি গানবোটযোগে সোজাসুজি পূর্বদিকে ভূঞাপুরে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। উল্লেখ্য, জাহাজ খোয়ানোর পর ভূঞাপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎখাত অভিযানে নেতৃত্বে ছিল হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি।
শফিউদ্দিন তালুকদার

No comments

Powered by Blogger.