গোধূলির ছায়াপথে-‘পুড়িব একাকী’ by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

কী লিখছেন? এই মাত্র লেখা শেষ করলাম ‘পুড়িব একাকী’। ৩৩০ পৃষ্ঠা প্রিয় কবিকে নিয়ে ফিকশন। জীবনের গল্পটি তুলে এনেছি, রং চড়াইনি। প্রজাপতির পাখা রেঙে উঠেছে। ফিকশন, ইতিহাস নয়। বিদ্রোহ ও সুন্দরের কারণে হিন্দুরা অনুভব করছেন, মুসলমানরা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন একমাত্র নকিব, কমরেডরা খুঁজেছেন বঞ্চিতের জয়গান উদ্গাতাকে।


দশটি বছর সময় পান কবি জীবন মেলে দেওয়ার। সাম্প্রদায়িক মিলনের স্বপ্ন চুরমার করে দিতে ছুটে আসে মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা। প্রতিকূল সময়ের ঝড়ে পাল তোলে হিংসা-অপবাদের ছুরি, অপমান। বিক্ষত কবিমনকে ধীর সন্তর্পণে গ্রাস করে দারিদ্র্য, আঘাত, ব্যাধি।
সম্প্রদায়ের সমঝোতা না হতেই দেশ ভাগ। উপন্যাসের ময়ূরপঙ্খী কখনো চলে দুলকি চালে বাতাসের আবর্তে, কখনো ফিকশনের খরস্রোতে, স্বগত উচ্চারণে, কবিতায়, গানে, ভাষণে। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম মানসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে কবি, প্রবাহিত তিনি নিজ দুঃখনদীতে। কেউ নিতে পারেননি সে দুঃখভার।
ময়লা কথা ময়লা বাক্সে। শেষের দিনে ঘাড়ে, মাথায় নিয়েছেন আঘাত। পিতৃবন্ধু কে. মল্লিকের কথন সত্যি বলে গ্রহণ করেছি। বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি অসুস্থ, আর ওই দিন থেকে তাঁর অসুস্থতা বেড়েই চলে, চিকিৎসা হয় বহুদিন ধরে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বাক। আপনার মনে পুড়েছেন একাকী গন্ধবিধুর ধূপ। এরপর আর গল্প নেই।
পাঠক আগ্রহ ভরে জানতে চায় অন্তর্গত মানুষটির গল্প, কবিপ্রাণ, অবস্থান যার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ও বাংলাদেশের বাঙালি মননে। সমসাময়িকদের স্মৃতিবাসরে সযতনে কুড়ানো সংলাপ, পথের ধারের তৃণলতাটুকুও কথা বলে উঠেছে। ইথারে স্বগত সংলাপ, এত কথাও ছিল কবির গানের আড়াল, ভাষণের আড়াল। চারটি অভিনব সংযোজন। পরিশিষ্ট ১: সাহিত্যবাসর, পাঠক খুঁজে পাবেন কবিকে তাঁর নিজ পরিমণ্ডলে। পরিশিষ্ট ২: গান ও কবিতার আসরে কবির প্রিয়জন। পরিশিষ্ট ৩: নজরুল-ঘনিষ্ঠজনের নির্ঘণ্ট। পরিশিষ্ট ৪: ১৯৪২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত নজরুলকে সামনে নিয়ে এসেছেন যাঁরা।
পিতা বলেছিলেন: আমাকে ভালোবাস জানি, আমার চেয়েও ভালোবেস নজরুলকে, নজরুলের চেয়েও বেশি রাসুলকে। চেষ্টা করে গেছি। নজরুলের ভালোবাসার মানুষ রাসুল। নজরুলের সঙ্গে ছিল যাদের ওঠাবসা, কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ছোট জীবন, ব্যাপ্তি বিশাল, প্রয়োজন হাজার পৃষ্ঠার। কাতিব অশ্রুরুদ্ধ, লিখেছেন অল্পই। তার কেউ নই আমি, তবু উত্তরাধিকারীদের একজন। তার কোটি অনাত্মীয় পাঠক পড়বেন ঘনিষ্ঠতম কবির কাহিনি। প্রজন্মের অশ্রুভরা চোখে নামাবে বিষাদের বৃষ্টি, যা আমার ইচ্ছা ছিল না। একাকী পুড়েছে যে কবির হূদয়, জলসা শেষে ফিরে গেছেন প্রভুর কাছে। প্রতিবাক্য ভালোবাসার অশ্রুগাথা, গীতশেষে প্রার্থনা। রাজা-রানির জয়গানও গেয়েছেন, আবার অসহযোগের গান গেয়েছেন, এদের সঙ্গে নজরুলের কত তফাত, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী।
যার ধর্ম তার কাছে। পৃথিবীতে এত মানুষ। প্রতি মানুষের সমর্পণ ও সম্পর্ক তার নিজ প্রভুর সঙ্গে আলাদা। ধর্ম বাইরে থেকে শনাক্ত করা গেলেও ভেতরে ঢোকার সাধ্যি কার, প্রতি মানুষের সঙ্গে বিধাতা সেখানে একাকী, নজরুল, আমার, আপনার সবার ক্ষেত্রে। হিন্দু-মুসলমানের সমঝোতা হয়নি। আলাদা হলাম। মাটির কলসি ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। এখন আছি, থাকব ভাইয়ের মতো, হিংসার ঊর্ধ্বে।
নজরুল-গবেষক, নজরুলগীতির গায়ক-গায়িকা, জীবনী লেখক, প্রকাশক, পরিবেশক, অভিনীত ছায়াছবির লিস্ট প্রস্তুত হয়নি। সম্প্রতি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীনকে নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।
শ্যামল রমনা উদ্যান কয়েক মাইল জুড়ে। আকাশ ছুঁতে চায় শাল সেগুন কদম্ব বৃক্ষ। এত সুন্দর সবুজ মাঠ পৃথিবীতে কমই আছে। শহরের হূৎপিণ্ড, বর্তমান নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। লক্ষ মানুষ পায়ে পায়ে জমায়েত দুপুর থেকে। মানুষের ঢল কাতারবন্দী নবীন-প্রবীণ মধ্যবয়স্ক কিশোর। কবিকে দেখেননি অনেকেই। কবিতা পড়েছেন, গান শুনেছেন। কত কাতার কেউ গুনে দেখেনি। কয়েক লাখ মানুষ। পৃথিবীর আর কোনো কবির জানাজায় এত মানুষের সমাগম হয়নি।
কবির নাম নজরুল। তারিখ: রোববার, ২৯ আগস্ট ১৯৭৬।
তার আগে ১৯৫৭ সাল। টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী আহূত কাগমারীর ঐতিহাসিক সম্মেলন। লাখ লাখ মানুষের পদচারণে আলোড়িত জমায়েত। এক শ তোরণ সাজানো শ্রেষ্ঠ মানুষদের নামে। একটি: কাজী নজরুল ইসলাম তোরণ। সকাল থেকেই রটনা হয়ে গেছে কাজী স্বয়ং সভায় আসবেন, গান গাইবেন, কথা বলবেন।
সত্যি ভাই, কাজী নজরুল আসবেন?
মওলানা ভাসানী ফজরের পর তো তা-ই বলেছেন। সশরীরে উপস্থিত হবেন সেই কবি, যাকে খুঁজে ফেরে মানুষ।
উদ্বিগ্ন মানুষ এ ওকে জিজ্ঞেস করছেন, আমাদের নজরুল নাকি ভালো হয়ে গেছেন। তিনি আসবেন আজ সন্তোষের মাঠে। বিকেলে গান গাইবেন। আরেকজন বললেন, আমি শুনছি ভাই সাহেব, আব্বাসউদ্দীনও আইছেন, ওনার ছেলেও আইছেন।
নজরুল-আব্বাস-কে. মল্লিক এদের বাংলার গ্রামের হাটুরে, মাঠুরে, গীদাল, দোকানি, বৈঠার মাঝি, কোদালি, বড় দেওয়ানি, ছোট দেওয়ানি কেউ ভুলতে পারেনি, এত ভাঙাগড়ার পরও।
কোথায় নজরুল? কই আমাদের নজরুল? পুরো মাঠজুড়ে একই প্রশ্ন।
গ্রামের তরুণী এসেছে কয়েকজন সাথি নিয়ে। বাংলার নতুন তরুণী। নজরুলকে ভালোবাসে।
শিউলি ফুলের মালা তার জন্য। পরিয়ে দেবে প্রিয় কবির গলায়।
শিউলি শুকায়, কোথায় নজরুল? তুমি কোথায়?...
 মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.