মালয়েশিয়া শ্রমিক নেবে নাঃ সরষের ভূত তাড়াতে হবে

বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান উত্স জনশক্তি রফতানি খাতটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, বিভিন্ন কারণে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ভয়াবহ সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা, জনশক্তি রফতানি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর অকর্মণ্যতা এই সম্ভাবনাময় খাতটিকে আক্ষরিক অর্থেই পথে বসিয়ে দেয়ার মতো অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হলো সেই আশঙ্কার অনেকটাই। দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক তত্পরতা, অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে অবশেষে মালয়েশিয়া সরকার জানিয়ে দিয়েছে, সহসাই সে দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেবে না। স্বয়ং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের সাংবাদিকদের কাছে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ারই একটি আলামত!
কেন মালয়েশিয়া সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সম্পর্কে সে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থাগুলো কোনো রাখঢাক করেনি। গত ৩ ডিসেম্বর ‘মালয় মেইল’ পত্রিকা দাবি করেছে, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্টদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক, আবার তারাই শ্রমিক পাঠানো নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে। সে দেশের পত্রিকা ও বার্তা সংস্থা এও বলেছে যে, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানির কারণে সৃষ্ট নানা সমস্যার জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দায়ী। আর এ কারণেই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালয়েশিয়া। জানা গেছে, এর আগেও বাংলাদেশের দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনে গড়ে ওঠা দালালচক্রের কারণে বাংলাদেশী শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভুয়া কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানিকে প্রয়োজনাতিরিক্ত শ্রমিক চাহিদাপত্রে অনুমোদন দিয়ে সাবেক লেবার কাউন্সিলরই পায়ে কুঠারাঘাত করে গেছেন। ভুয়া ডিমান্ড লেটার দেয়ায় স্বভাবতই অতিরিক্ত শ্রমিকের সর্বনাশ হয়েছে, তারা চাকরি পাননি। বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও সরকার এ ধরনের লেবার কাউন্সিলর, দালাল এবং সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। অভিযোগ আছে, অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী দল ও টাস্কফোর্সের সদস্যরাই মোটা দাগের ঘুষ নিয়ে দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে গেছেন। এ টাকার ভাগ পেয়েছেন হাইকমিশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং তাদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত দালাল ও অসাধু আদম বেপারিরা। কথায় আছে, চোরের দশদিন, গেরস্থের একদিন। কিন্তু তাদের কী হবে—যেসব ভাগ্যহত শ্রমিক সহায়-সম্পদ বিক্রি করে খিদের জ্বালায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেয়েছেন, ফুটপাতে ব্রিজের নিচে ঘুমিয়েছেন অনাহারে-অর্ধাহারে, চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন, মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে? সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এসব খবর রাখে না? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে বিলম্ব হওয়ার জের ধরেই আলোচ্য সঙ্কট এখন বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে। যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার কথা বাংলাদেশের, তা যেন শেষ পর্যন্ত করতে হলো মালয়েশিয়া সরকারকে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ এবং ২০০৭ সালেও মালয়েশিয়া সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা পাল্টায়। জানা গেছে, গত নভেম্বরে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ইতিবাচক সাড়া দেননি মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী। এরপর নানা পর্যায়ে কূটনৈতিক তত্পরতা চলে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মালয়েশিয়া যান। কিন্তু সিদ্ধান্তে অনড় থাকে মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ।
এদিকে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার সৌদি আরব, কুয়েত, ব্রুনাই, ওমান, মরিশাসে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ রয়েছে। মিসরে চার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সংঘবদ্ধ চক্রের যোজসাজশে। সব মিলিয়ে অশনি সংকেত, বিপর্যস্ত বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।
এই দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকে জনশক্তি রফতানি খাতকে বাঁচাতে হলে কূটনৈতিক তত্পরতা আরও জোরদার করার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরষে থেকে ঝেটিয়ে তাড়াতে হবে সব ধরনের ভূত। জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজকে রক্ষা করার কোনো কৌশল অবলম্বন করলে তার ফলাফল হবে নেতিবাচক, যা হয়েছে মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে। কাজেই সাধু সাবধান।

No comments

Powered by Blogger.