গত আমলের প্রায় দেড় হাজার মামলা প্রত্যাহারঃ ছাত্রদের মামলা কিন্তু রয়ে গেছে

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তাণ্ডবে সবাই যখন আতঙ্কগ্রস্ত, তখনই রুখে দাঁড়িয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্ররা। তারা ছাত্রসমাজের অকুতোভয় ঐতিহ্য বজায় রেখেই রাজপথে নেমে এসেছিল ২০০৭ সালের ২০-২২ আগস্ট। মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসী রুদ্ধশ্বাসে তা প্রত্যক্ষ করেছে।
আশায় বুক বেঁধেছে, অসাংবিধানিক শাসনের অবসানে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরে আসবেই। দু’বছর দুঃশাসনের পর বর্তমানে দেশে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও সেই ছাত্ররা রেহাই পায়নি। অসাংবিধানিক সরকারের দায়ের করা মামলায় গত ১৩ ডিসেম্বর চার ছাত্রের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তির আগমুহূর্তে এমন ঘটনা গণতন্ত্রের বিজয়কে কালিমালিপ্ত করবে সন্দেহ নেই।
অথচ ২০০৭ সালের আগস্টের ছাত্র বিক্ষোভ নিয়ে গর্ববোধ করতে কেউই, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা পিছপা হয় না। জরুরি অবস্থার দমবদ্ধ সময়ের মতো এখনও ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যের কথা বলতে সবাই উত্সাহী হয়ে ওঠেন। যা বাস্তবসম্মত বটে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তী সময়েও ছাত্ররাই গণতন্ত্র রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এজন্য চরম মূল্য দিতেও পিছপা হয়নি ছাত্রসমাজ। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক্ষেত্রে অগ্রগামী থেকেছে বরাবরই। আগস্টের ছাত্রবিক্ষোভে সংঘাত, সংঘর্ষ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একাধিক মামলা হলেও পরবর্তীকালে বেশিরভাগই টেকেনি। অবশ্য ওইসব মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক ও আট ছাত্রকে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটতে হয়েছে। একটি মামলায় আদালতের রায়ে সাজা হলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় তারা মুক্তি পান। উচ্চ আদালতে আপিল করে তারা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণিত করেছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলাটি আজও প্রত্যাহার করা হয়নি। জরুরি অবস্থার ভূতের মতোই সেটা এখনও চেপে বসে আছে। সে মামলাতেই গ্রেফতারি পরোয়ানার মুখে পড়েছে চার ছাত্র।
আওয়ামী মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার শুরু করে। জেলায় জেলায় গঠিত কমিটির কাছ থেকে পাওয়া তালিকা অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫৮টি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তবে প্রত্যাহৃত মামলাগুলো প্রায় সবই আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা। বিএনপি নেতাকর্মীসহ অন্যদের মামলাগুলো ধর্তব্যে না নেয়ায় পানি অনেক ঘোলা হলেও কেউই গা করেননি। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু বিরোধী দলই নয়, ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাও প্রত্যাহার করার প্রয়োজন বোধ করেনি সংশ্লিষ্টরা। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাস ও উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তার দেখা না পাওয়ায় ক্ষোভ সঞ্চার হওয়াই স্বাভাবিক। মধুর কেন্টিনের সংবাদ সম্মেলনে হয়রানির শিকার ছাত্রদের মুখে তেমন বাক্যই উচ্চারিত হয়েছে। তারা সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
অনেকেই বর্তমান সরকারকে জরুরি অবস্থার সরকারের ধারাবাহিকতা বলে উল্লেখ করে থাকেন। সে সরকারের সব কাজের বৈধতা দেয়ার কথাও অতীতে কারও কারও মুখে শোনা গেছে। তখন দায়ের করা মামলা নিয়ে এখন যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে যে কেউ বর্তমান সরকারের ভূমিকা নিয়ে সে ধরনের প্রশ্ন তুলতেই পারেন। বাস্তব কাজ দিয়েই সরকারকে এর জবাব দিতে হবে। শুধু কথায় এখন আর রাজনীতিকদের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। এ অবস্থা যে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরাই সৃষ্টি করেছেন—এটা অস্বীকার করা কঠিন। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার নিয়ে সরকার সে কথাই নতুন করে প্রমাণ করেছে। নিজদলীয় লোকজনের মামলার মতো অন্যদের, বিশেষ করে ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে দেরি হলে মানুষের মনে ভিন্ন ধারণা বদ্ধমূল করে তুলবে।

No comments

Powered by Blogger.