একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-মোবাইল ফোন কি-প্যাডের প্রমিতকরণ by মুনির হাসান

ভাষার টিকে থাকা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। তবে আমরা যাঁরা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি, তাঁরা খুব সহজে এই বিতর্কের মীমাংসা করতে পারি। কারণ, আমরা জানি, শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকবে সেই ভাষাগুলো, যা কিনা প্রযুক্তিবান্ধব! সাধারণ একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যেসব ভাষার লিখিত রূপ নেই,


সেই ভাষাগুলোর অধিকাংশই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। তারপর যখন গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলেন, তখন ভাষার একটি সিসা-রূপ আমরা দেখলাম। তারপর শুরু হলো সিসাবিহীন ভাষার বিলোপ। আর এখন এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি। এখন কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষাবিদদের পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদদেরও সক্রিয় হতে হবে। তাঁরা নিত্যনতুন প্রযুক্তিতে তাঁদের মায়ের ভাষাকে যুক্ত করবেন। তথ্যপ্রযুক্তির বেলায় এ ঘটনা ঘটতে হবে হাতের এবং টেবিলের সব প্রযুক্তিপণ্যে। বাংলাদেশে এখন প্রায় সাড়ে আট কোটি লোকের মোবাইল ফোন আছে। তাঁদের মধ্যে কমবেশি সাড়ে চার কোটি নিয়মিত মোবাইল ফোনে কথা বলেন। সেই মোবাইল ফোনে টিকিয়ে রাখতে হবে বাংলা ভাষাকে।
মোবাইল ফোন, কম্পিউটার বা সে রকম যন্ত্রের নিজের অনেক ভাষা নেই। তারা এক বাইনারি (০-১) ভাষায় কথা বলে। আমাদের ভাষা রক্ষাকারীদের কাজ হচ্ছে এমন একটি ম্যাপ বানিয়ে দেওয়া, যেখানে আমাদের ভাষার লিপিগুলো যেন ০-১-এর বিভিন্ন বিন্যাসে প্রকাশিত হতে পারে। এটি প্রমিত হলে ভালো হয়। কারণ, প্রমিত না হলে যার যেমন খুশি ম্যাপিং করবে এবং ফল হবে মারাত্মক। কম্পিউটারে বাংলা লিখতে গিয়ে আমরা ‘যার যেমন খুশি ম্যাপিং’-এর শিকার হয়েছিলাম। বিশ্বব্যাপী অবশ্য এটির প্রমিতকরণ হয়ে গেছে ইউনিকোডের আবির্ভাবে।
মোবাইল ফোনেও যে এমনটি হবে না, তা বলা মুশকিল। কারণ হলো, আধুনিক উন্নত জাতের চৌকস ফোনগুলো বাদ দিলে, বেসিক মোবাইল ফোনে মাত্র ১২টি বোতাম বা কি থাকে। এটিকে বলা হয় কি-প্যাড (যেমনটি কম্পিউটারের কি-বোর্ড)। যেহেতু নম্বর দিয়ে ফোন করাটাই মুখ্য কাজ, মোবাইল ফোনের কাজে সেখানে ০-৯ এই ১০টি অঙ্ক এবং দুটি বিশেষ বোতামে কতিপয় চিহ্ন (*, # ইত্যাদি) থাকে। যবে থেকে বোঝা গেল ফোন দিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো সম্ভব, তখন থেকেই এটিকে প্রমিত করার দরকার দেখা দেয়। বেশির ভাগ কর্তৃত্বপরায়ণ বিজ্ঞানী ইংরেজিতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কাজেই ইংরেজি দ্রুতই প্রমিত হয়ে গেল। মুশকিল হলো, আমাদের মতো ভাষার লোকদের। আমাদের প্রায় ৫০টি চিহ্ন এবং যুক্তাক্ষর মিলিয়ে নানা হ্যাপা। এই সমস্যাগুলোই আমাদের সমাধান করতে হয়েছে সহজ কিছু বুদ্ধি খাটিয়ে।
দেখা গেল, কমবেশি ৭২টি চিহ্ন আমাদের রাখতে হবে এই ১২টি বোতামে। সহজ হিসাবে ছয়টি করে রাখলে হয়। (ইংরেজিতে মাত্র তিনটি করে বর্ণ রাখতে হয়েছে।) কিন্তু দেখা গেল, ছয়টি করে রাখলে হচ্ছে না। প্রথমে যুক্তাক্ষর তৈরি করার জন্য সফটওয়্যারকে একটি নির্দেশ দিতে হয় (এনকোডিং পরিভাষায় জয়নার)। এর সঙ্গে কোনো কোনো চিহ্ন রাখলে বলা বাহুল্য অনেক বিপদ। এরপর আমাদের বর্ণ খোঁজার অভ্যাসও মনে রাখতে হবে। আপনি যেখানে ‘ক’ বর্ণটি রাখবেন, তার পরপরই যদি ‘ঙ’ রাখেন, তাহলে কোনো ক্রম থাকবে না! এ কারণে ব্যঞ্জনবর্ণের বর্গীয় বর্ণগুলোকে রাখা হলো একভাবে। ১১টি স্বরবর্ণের জন্য দুটি বোতাম ঠিক করা হলো। তবে অপ্রচলিত বা কম ব্যবহূতগুলো রাখা হলো শেষের দিকে। এরপর বাকি থাকল আকার, ই-কারগুলো। সেগুলোকে সাজানো হলো। সিদ্ধান্ত নিতে হলো, কোন বোতামটি হবে সংযুক্ত বর্ণ।
অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এখানেও আমরা যথেষ্ট দেরিতে শুরু করি। ফলে বাংলা কি-প্যাডসহ মোবাইল ফোন কিন্তু বাজারে চলে আসে তার আগেই। নকিয়ার বাংলা কি-প্যাডসমৃদ্ধ মোবাইল ফোনসেট আমরা কয়েক বছর ধরেই দেখছি। প্রমিতকরণ করতে গিয়ে তাই এসব বিষয়েও ভাবতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে কারিগরি ব্যাপারটাও। ইউনিকোডের কারণে কোডিংয়ের সমতা অবশ্য আগেই সমাধা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রমিতকরণ সংস্থা (বিএসটিআই) যে কি-প্যাডটি প্রমিত করেছে, সেটির ছবি দেওয়া হলো এখানে। এ রকম প্রমিত বাংলা কি-প্যাডসহ মোবাইল ফোনসেট বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য সব মোবাইল ফোনসেট নির্মাতাকে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে বাংলাদেশে আনা সব সেটেই প্রমিত বাংলা কি-প্যাড থাকবে।
মুনির হাসান
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি

No comments

Powered by Blogger.