মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অনুসমর্থন অপরিহার্য-সীমান্ত ও ছিটমহল সমস্যা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সফলতা-বিফলতা নিয়ে ঢাকা ও দিল্লিতে যখন চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে, তখন দুই দেশের ছিটমহলের বাসিন্দারা দাবি আদায়ের শেষ অস্ত্র হিসেবে অনশন ধর্মঘট করছে। সফরের আগে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে এ ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে এবার ৬৩ বছরের
বকেয়া সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রটোকল নামে যে বস্তুটি দুই পক্ষ সই করেছে, তা যেমন অস্পষ্ট, তেমনি অনির্দিষ্ট। তাই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত দুই দেশের ছিটমহলবাসী আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে।
প্রটোকলে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হলেও কবে নাগাদ এবং কীভাবে ইনস্ট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশনসের বিনিময় ঘটবে, সে ব্যাপারে কোনো কথা নেই। আজ থেকে ৩৭ বছর আগে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সই হওয়ার অব্যবহিত পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ তা অনুসমর্থন করলেও অদ্যাবধি ভারত তা করেনি। এমনকি ১৯৯০ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি নয়াদিল্লি। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম মনমোহনের বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে একটি ব্যাপকভিত্তিক বিবৃতি সংসদে পেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সংসদে অনুসমর্থনের জরুরি বিষয়টি অনুচ্চারিত থাকছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের স্মরণ রাখা দরকার, ওই চুক্তি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অংশে পরিণত হয়ে আছে কিন্তু তারও চূড়ান্ত কার্যকারিতা অনুসমর্থনের ওপরই নির্ভরশীল। স্থলসীমান্তের অগ্রগতিটা এখন সাপ মেরে লেজে বিষ রাখার মতো।
এত শোরগোল তুলে যেই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এলেন, তার অর্জন কী? বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি হয়নি। তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হলেও চুয়াত্তরের চুক্তিতে বর্ণিত ‘অনন্তকালব্যাপী অধিকারমূলক ইজারার’ শর্ত পূরণ করেছে, তা কোথাও বলা হয়নি, বরং করিডরে ভারতীয় রক্ষীদের টহল রয়েছে। যেহেতু করিডরের দুই দিকেই ভারতীয় ভূখণ্ড, সেহেতু সেখানে যৌথ টহলের ব্যবস্থা রাখাই বাঞ্ছনীয়। তাতে ছিটমহলবাসী এবং ভারতীয় নাগরিক—উভয়ই নিরাপদ বোধ করবে।
ভারত যে ৪৬টি পণ্যের ওপর শুল্কসুবিধা দিয়েছে, তা নিয়েও খুব আশাবাদী হতে পারছেন না বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় তাঁদের আশঙ্কা অমূলক নয়। অশুল্ক বাধা দূর না করলে এই শুল্কসুবিধা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহল শুল্কমুক্ত সুবিধার বিরোধিতা শুরু করেছে। এর আগেও দেখা গেছে, বাণিজ্যক্ষেত্রে ভারত সরকার কোনো ছাড় দিলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকানো হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
প্রশ্ন উঠেছে, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সইয়ের ৩৭ বছর পর প্রটোকল সই হয়েছে, এটি কার্যকর করতে আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হবে? নতুন প্রটোকলটিকে যেহেতু চুয়াত্তরের চুক্তির অংশে পরিণত করা হয়েছে, তাই তার অনুসমর্থন ছাড়া এটি আইনের চোখে অকার্যকর দলিলই থেকে যাবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ইশতেহারে ‘অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নের’ অঙ্গীকারের প্রতি ভুক্তভোগীদের ভরসা রাখতে না পারাটাই স্বাভাবিক।

No comments

Powered by Blogger.