ঋণসংকট-ইউরোপজুড়ে গণ-অসন্তোষ by পিটার কাস্টার্স

ইউরোপের সংকট স্পষ্টতই মার্কিন ঋণসংকটের ধারাবাহিকতা। তাই এ সংকট বিশ্লেষণেও অন্তর্দৃষ্টি দরকার। গত ২১ জুলাই ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সরকারি প্রতিনিধিরা গ্রিসের জন্য ঋণের নতুন প্যাকেজে সম্মতি দিয়েছেন। গ্রিস যাতে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে তার বাধ্যবাধকতা পূরণে খেলাপি না হয়, সে জন্য এই আগাম প্যাকেজ।


এই নতুন প্যাকেজটি কিন্তু ইউরোপের ঋণসংকট অবসানের ইঙ্গিত দেয় না, বরং গত বছরের প্রথম প্যাকেজটি যে ব্যর্থ, সে বার্তাই দেয়। ইউরোপের আর্থিক বাজারে ধস অব্যাহত আছে। গ্রিস শেষ পর্যন্ত খেলাপি হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘প্রান্তিক’ রাষ্ট্রগুলোর ওপর তার ডোমিনো অ্যাফেক্ট পড়বে। ইউরো অঞ্চলও বাদ পড়বে না, তাই ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই রাজনীতিক—ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল—তাড়াহুড়ো করে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। বৈঠকে উঠে আসা কথায় নতুনত্ব আছে। যেমন বলা হয়েছে, ইউরোপে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ এখন থেকে সমন্বিত হওয়া উচিত। আর্থিক লেনদেনের ওপর করারোপের ব্যাপারে ওই দুই নেতা সম্মত হয়েছেন। কিন্তু এসব ঘোষণা বিরাট সন্দিগ্ধচিত্তে গৃহীত হয়। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটির পর কয়েক দিন ইউরোপের আর্থিক বাজারে শেয়ারের দাম পড়তে থাকে।
মাত্র দুই সপ্তাহে ইউরোপের কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ারমূল্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পতন ঘটে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব এখন একটা নয়, দুটি বড় ধরনের ঋণসংকটে জর্জরিত। আর এখন যে প্রশ্নের জবাব জরুরি ভিত্তিতে দেওয়া দরকার, তা হলো: ইউরোপকে তো নিজের সংকট সমাধানে অপারগ মনে হচ্ছে, ব্যাপারখানা কী?
এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে ইউরোপের দুর্বলতম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত গ্রিসের বিষয়টি যাচাই করে দেখা যাক। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ছড়িয়ে পড়ার সময় বেশির ভাগ পশ্চিমা রাষ্ট্র তাদের টলায়মান ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ করার পথে যায়। সংকটের আগে ইউরো অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো বাজেট ঘাটতি সুস্পষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে বাধ্য ছিল। কিন্তু সংকট শুরুর পর এই নিয়ম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। ইউরোপের বেশির ভাগ রাষ্ট্রের ঋণ দ্রুত বেড়ে যায়। এভাবে ২০১০ সালে জার্মানির সরকারি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ—সাত ট্রিলিয়ন ইউরোতে গিয়ে ঠেকে। আগের বছরের থেকে এটা ১৮ শতাংশ বেশি। জার্মানির জিডিপির ৮০ শতাংশের সমান।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম খুঁটি হিসেবে বিবেচিত ইতালির সরকারি ঋণ জিডিপির ১২০ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। সুতরাং শুধু গ্রিস নয়, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারেনি। তথাপি গ্রিস বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। কেননা, ইউরো অঞ্চলের আর কোনো দেশ গ্রিসের মতো নির্মম জল্পনা-কল্পনার টার্গেট হয়নি। গ্রিসের সরকারি ঋণ জিডিপির ১৫৩ শতাংশ হওয়ার পরও ঋণদাতাদের সুদ পরিশোধ করতে গ্রিসকে বাধ্য করা হয়েছে। এটা পুরোদস্তুর সুদখোরি। ফরাসি ও জার্মান ব্যাংকের মতো বেসরকারি ঋণদাতাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ গুনতে হচ্ছে প্রায় ১৫ শতাংশ করে। সুদের এই হার ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য কোনো দেশকে পরিশোধ করতে হয় না। জার্মান অর্থনীতিবিদদের কারও কারও মতে, এটা উপকারী এ জন্য যে এতে গ্রিসের ভেতরকার পরিস্থিতি সুশৃঙ্খল থাকতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু সুদের উচ্চহার দেখে বোঝা যায়, ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলো এই ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ইউনিয়নের ওপর এবং ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করে।
গ্রিসের ওপর শৃঙ্খলাজনিত যেসব ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে, সেখানকার বিস্ময়কর অদক্ষতা লক্ষণীয়। গত বছর গ্রিস যখন ঋণের অর্থ পরিশোধে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) মিলে একটা ‘সহায়তা’ প্যাকেজ প্রণয়ন করে, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল সামাজিক ব্যয়সংকোচন ও সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কমানোর মতো অদক্ষ কৃচ্ছ্রমূলক ব্যবস্থা। তবে ৫৬ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রি করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। নয়া উদারবাদী সময়ের পুরোটায় আইএমএফের ‘সহায়তা’ প্যাকেজের সুপরিচিত শর্ত কৃচ্ছ্রমূলক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় কোম্পানির বেসরকারীকরণ। কিন্তু গ্রিসের ক্ষেত্রে যত দ্রুত এসব শর্ত চাপানোর বিপজ্জনক চরিত্র স্পষ্ট হয়েছে, তেমনটা দ্রুত সচরাচর দেখা যায় না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেখানে গ্রিসের সরকারি বাজেটে ভারসাম্য আনা ‘অর্থনীতিকে সচল’ করার জন্য আবশ্যক হিসেবে দেখায়, কিন্তু বাস্তবে তো ঘটেছে তার উল্টো। গত বছর গ্রিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ঋণগ্রহীতা এক বছরে যে পরিমাণ উ ৎ পাদন করতে পারে, ঋণ যদি সেই সীমা ছাপিয়ে যায় আর ঋণগ্রহীতার ঋণের ওপর সুদের হার হয় ১৫ শতাংশ, তাহলে তার সম্পদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ—এ কথা শিশুও বোঝে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণগ্রহীতা আরও ডোবার সম্ভাবনা। তাই গ্রিসের ওপর আরোপিত শর্তাবলি অত্যন্ত অন্যায্য। এটা গ্রিসকে খেলাপি হওয়ার আরও কাছে ঠেলে দিয়েছে।
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত ব্যবস্থা সারা ইউরোপে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। গত অক্টোবরে ফ্রান্সের শ্রমিকেরা বিরাট ধর্মঘট করেন, স্পেনে নতুন যুব আন্দোলনের সূচনা ঘটে চলতি বছরের শুরুর দিকে, আর ইংল্যান্ডে গত মাসে বেকার যুবকদের সহিংস দাঙ্গার বেশ আগে কৃচ্ছ্রবিরোধী জঙ্গি আন্দোলনের সূচনা ঘটে। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বাজেট হ্রাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে ক্যামেরন সরকারের বিরুদ্ধে। আর ভোডাফোনের মতো আরও অনেক করপোরেশনের কর ফাঁকির বিরুদ্ধে বেশ কিছু গোষ্ঠী ডিরেক্ট অ্যাকশন কর্মসূচি পালন করে। তবে একমাত্র গ্রিসে কৃচ্ছ্রবিরোধী প্রতিবাদ দ্ব্যর্থহীনভাবে গণ-আইন অমান্যতায় রূপ নেয়। একদিকে দেশটির প্রধান প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়, অন্যদিকে গ্রিসের প্রায় ৫০ শতাংশ জনগণ ‘আমরা কর দেব না’-কে সমর্থন করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। সড়কের কর দিতে লোকে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। সড়কের কর-ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করে জনগণ। রাজধানী এথেন্সের নাগরিকেরাও সড়কের মেট্রো টিকিটের দাম দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আর দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তর নগর থেসালোনিকিতে জনগণ বাসভাড়া বর্জন চালিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারীকরণ-বিরোধী ও সড়ক করবিষয়ক বিক্ষোভের ফলে গ্রিসের পার্লামেন্ট ও সরকার এখন রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
ইউরোপে এখন নীতিনির্ধারক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। অথচ সংকটের বোঝা টানতে হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষকেই। ২০০৮ সালের সংকট অর্থনৈতিক খাতের ক্ষমতাকে বশে আনা এবং আরও বেশি করে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরে। তবু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর সদস্যরাষ্ট্রগুলো কোনো জনগণ-কেইনসীয় নীতি প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ভোক্তার চাহিদা ও বিনিয়োগ উদ্দীপিত করতে ব্যবস্থা নিয়েছিল। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো পুরোনো বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে—সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে তাদের বাজেটে ভারসাম্য আনতে বলছে ‘নয়া-উদারতাবাদের’ কোনো বিকল্প বিকশিত না করেই। সার্বভৌম ঋণ নিয়ে সংকটের যখন বিস্তার ঘটেছিল, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাধ্যবাধকতা বোধ করেছিল ইউরোপীয় ব্যাংকের শক্তি আংশিকভাবে মোকাবিলা করার। ৪৪০ বিলিয়ন ইউরোর একটি ইউরোপ পর্যায়ের জরুরি তহবিল গঠন করেছিল এবং ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা বাড়িয়েছিল। তবু ইউরোপের স্টক এক্সচেঞ্জের আগস্ট মাসের পরিস্থিতিতে স্পষ্ট হলো অর্থনৈতিক বাজারকে বশে আনতে সেসব ব্যবস্থা নিতান্ত অপ্রতুল। ইউরোপের নেতারা এখন ইউরো বন্ড ছাড়ার কথাও ভাবছেন। কিন্তু ইউরোপীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে আরও ব্যাপকতার পরিবর্তন যে দরকার, তা অনেকে উপলব্ধি করছেন না। এখনো ব্যাংকগুলো ইউরোপের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। প্রশ্ন জাগে, ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের ঘুম ভাঙবে কবে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.