মৃদুকন্ঠ-গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র ও কল্যাণতন্ত্র by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়া। জনগণের ইচ্ছা অনুসারে, জনগণের জন্য, জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। শাসনব্যবস্থায়ও প্রকারভেদ রয়েছে। কিন্তু সব ধরনের রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে অর্থনীতির প্রগাঢ় সম্পর্ক। অর্থনীতি-নিরপেক্ষ কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমাদের জানা নেই। বিশ্বে কোনো উদাহরণও নেই।


গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক অধিকার চর্চার নিশ্চয়তা থাকে। মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, বিশ্বাস ধারণ ও চর্চার অধিকার, আত্মরক্ষার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, আইনানুগ উপার্জনের অধিকার, মেধাচর্চার অধিকার_এ সবই গণতন্ত্রে স্বীকৃত। স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র প্রভৃতির সঙ্গে গণতন্ত্রের পার্থক্য এখানেই। কমিউনিস্ট শাসনকে 'জনগণতান্ত্রিক' বলা হলেও জনগণের ব্যক্তি-অধিকার নিশ্চিত নয় বলে এটা প্রথাগত গণতান্ত্রিক শাসন নয়। অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থাকলেও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা নেই। কমিউনিস্ট শাসনে ভিন্ন দল গঠনের অধিকার নেই, ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার নেই, আন্দোলনের অধিকার নেই, সরকারি নীতির সমালোচনার অধিকার নেই; এমনকি ব্যক্তিগত অধিকারও খর্বিত। তাই কমিউনিস্ট শাসনকে গণতান্ত্রিক বলা হয় না।
গণতন্ত্র উন্মুক্ত। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অর্থনীতিকেও উন্মুক্ত হতে হবে। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সঙ্গে গণতন্ত্র স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। উন্মুক্ততা বা মুক্তধারাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে গণতন্ত্র ও অর্থনীতির সেতুবন্ধ হিসেবে। এখানেই সম্ভাবনা এবং এখানেই দুর্ভাবনা।
মুক্ত অর্থনীতি একটি কন্টিনিউয়াম বা চল-রেখা, যার মুক্ততম বা উলঙ্গ পর্যায় হলো বেপরোয়া পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র। এর সঙ্গে জনস্বার্থ ও নৈতিকতার পোশাক যুক্ত হলে রূপান্তর ঘটে বাজারমুখী কল্যাণবাদে। দুটোই মুক্ত অর্থনীতি_একটি উলঙ্গ, অন্যটি পরিশীলিত পোশাকে সজ্জিত। একটি দৃষ্টিকটু, অন্যটি দৃষ্টিনন্দন। একটি শোষণের হাতিয়ার, অন্যটি কল্যাণের হাতিয়ার। একটি বল্গাহারা লোভের বহিঃপ্রকাশ, অন্যটি ন্যায়সংগত লাভের নির্দেশক।
কট্টর পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চেহারাটা কেমন? প্রথমে সেটাই বিশ্লেষণ করা যাক। এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনীতির রাশ টেনে ধরে না রাষ্ট্র। বাজার স্বাধীন, ধনিকরা স্বাধীন, লোভ সীমাহীন। 'সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট', অর্থাৎ যোগ্যতমেরই বাঁচার অধিকার। সেই যোগ্যতা অর্থসম্পদের জোরেই হোক, ক্ষমতার জোরেই হোক, নির্লজ্জ লুণ্ঠনের জোরেই হোক। লুণ্ঠন করার দক্ষতাও যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত।
উলঙ্গ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধনসম্পদই চালিকাশক্তি। সম্পদ যার হাতে, ক্ষমতাও তার হাতে_রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক হলেও। প্রশ্ন উঠতে পারে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করেন, আর বিত্তশালীরা বিত্ত অর্জন করে বাণিজ্য বা লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায়। দুটি তো ভিন্ন গোষ্ঠী। তাত্তি্বকভাবে এমনটাই। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। শিক্ষিত ও উন্নত গণতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক একটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একেকজন প্রার্থীর নির্বাচনী খরচ কত? কয়েক শ মিলিয়ন ডলার। আসে কোত্থেকে? দেশের বিত্তশালীরা চাঁদা দেয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর চাঁদাদাতা প্রভাবশালীরাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৮ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে যখন ধস নামল, শতবর্ষী প্রাচীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বালুর পাহাড়ের মতো ধসে পড়তে লাগল একের পর এক, বিত্তশালীরা যখন বিত্তহারা হতে লাগল, তখন সরকার জনগণের ট্যাঙ্রে অর্থ থেকে হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের সাপোর্ট প্যাকেজ ঘোষণা করল। জনগণের টাকা দিয়ে বিত্তশালীদের সাহায্য করল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন জনগণের কিছুটা সাহায্যের মানসিকতা নিয়ে স্বাস্থ্য বিল উত্থাপন করলেন, তখন বিত্তশালীরা কেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা নিশ্চয়ই স্মরণে রয়েছে। তাহলে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক কে? জনগণ, নাকি বিত্তবানরা? উলঙ্গ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাংবিধানিক ক্ষমতায় থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা বিত্তবানদের হাতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে অনেক মুখরোচক ঘটনা শোনা যায়। বর্তমান ঘটনাটি সম্ভবত প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে নিয়ে। কেনেডি নির্বাচিত হলেন। প্রথাগতভাবে নির্বাচনে আর্থিক সহায়তাকারী বড় বড় বিত্তবান অথবা তাদের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদের জন্য মনোনীত হলেন। ভুলক্রমে একজন বাদ পড়ে গেলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে সটান হাজির হলেন প্রেসিডেন্টের সামনে। বললেন, 'মি. প্রেসিডেন্ট, ভাগ-বাটোয়ারা তো শেষ করে ফেলেছেন। আমার স্থানটি কোথায়?' সপ্রতিভ কেনেডি বুকের ওপর হাত রেখে বললেন, 'আপনার স্থান এখানে। হৃদয়ের মাঝখানে!' কথায় চিঁড়া ভেজেনি। নির্বাচনী সহায়তা নেহাত কম ছিল না তাঁর। অগত্যা কিছু একটা করতে হয়েছিল তাঁর জন্য। কারণ ধনতন্ত্রে হৃদয়ের স্থান নেই। স্থান আছে শুধুই সম্পদের, শুধুই ক্ষমতার।
স্বল্পোন্নত এবং অনুন্নত 'গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রের অবস্থা আরো খারাপ। স্বল্পোন্নত বিধায় সুশাসন গড়ে ওঠে না, জনগণ ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠতে পারে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও সত্যিকার অর্থে ক্ষমতাবান হন না। জনপ্রতিনিধিরা বিত্তবান এবং অনির্বাচিত ক্ষমতাবানদের অভিরুচি, এমনকি নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। বাইরে থেকে মনে হবে, নির্বাচিতরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। কিন্তু নিবিড়ভাবে পরখ করলে ফুটে উঠবে অন্য চিত্র। নাট্যমঞ্চে অভিনেতারা অভিনয়কালে যেসব ডায়লগ আওড়াতে থাকেন, তা মুখস্থ করে আসতে হয়। ভুলে গেলে উইংসের ওপাশ থেকে প্রম্পটার মনে করিয়ে দেন। অভিনেতা অভিনয় করে যান। নিজের পছন্দমাফিক কিছু করার ক্ষমতা তাঁর নেই। স্বল্পোন্নত দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের নেতাদের অবস্থা ওইসব অভিনেতার মতো। নিজেদের চিন্তাচেতনা নিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ কঠিন হয়ে পড়ে। বিত্তবানদের ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত হয়ে কাজ করে থাকেন তাঁরা। তাই সর্বত্রই কম্প্রোমাইজ। এমনভাবে চলতে চলতে দেখা যায়, বিত্তহীনদের ক্ষমতা বলয়ে প্রবেশের অধিকার সীমিত হয়ে এসেছে। বিত্তবানরা নিজেরাই চেয়ারগুলো দখল করে ফেলছেন। আমাদের দেশেই দেখা যাক। ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় সংসদে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। বিত্তবানদের অবস্থান কখনো উল্লেখযোগ্য ছিল না। তবে মধ্যবিত্তের অবস্থান আগাগোড়াই শক্ত ছিল। মধ্যবিত্তসুলভ এক ধরনের নৈতিকতা নিয়ে তাঁরা জনসেবার কাজ করতেন। তাঁরা অনেকেই চিত্ত বা মননের প্রসারতার উদাহরণ রেখেছেন, যদিও মৃত্যুর পর তাঁদের বিত্তের তালিকা প্রসারিত ছিল না। কিন্তু বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের অবস্থা কি তেমন? চিত্ত-মননের প্রসারতা ক্ষয়িষ্ণু হলেও বিত্তের প্রসারতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যেও ব্যতিক্রম রয়েছেন। তাঁরা কত দিন টিকে থাকবেন? অর্থ না থাকলে নাকি নির্বাচনই করা যায় না। যে অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন বলে শোনা যায়, তা শুনলে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্বাচিত হলে অন্তত ওই পরিমাণ অর্থ আয় করে ফেলতে হয়। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অতিরিক্ত উপার্জনও প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিকে তখন 'জন'-এর চেয়ে 'ধন'-এর দিকেই নজর বেশি দিতে হয়। গণতন্ত্রের ঘাড়ে চেপে ধনতন্ত্রের উন্মুক্ততা তথা উন্মত্ততা বাড়তে থাকে। রাষ্ট্র ধাবিত হয় বল্গাহারা উলঙ্গ অর্থনীতির দিকে।
এমনটা যে ঘটতেই হবে, তা অবধারিত নয়। গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতায় আসতে হলে জনসমর্থন প্রয়োজন। মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্তরা যদি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়, তাহলে বিত্তবানরা সংযত হতে বাধ্য হয়। সে ক্ষেত্রে শর্ত হলো_(ক) দেশের স্বল্প ও মধ্যবিত্ত মানুষকে অধিকার সচেতন হতে হবে, (খ) তারা বিত্তবাননির্ভর হবে না, (গ) বিত্তবানরা স্বল্পসংখ্যক হলেও ক্ষমতার পেছনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে না।
স্বল্পসংখ্যক বিত্তবান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নির্বাচিতদের তখনই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নীরব থাকে। নীরব থাকে এ জন্য যে তারা অসংগঠিত। সংগঠিত না হলে সোচ্চার হওয়া যায় না। নাগরিক সংহতির সংগঠন হতে পারে রাজনৈতিক দল। সমস্যাটা এখানেই। স্বল্পবিত্ত-বিত্তহীন সাধারণ নাগরিকদের জন্য নিঃস্বার্থ কমিটমেন্ট থাকলেই মাত্র রাজনৈতিক দল জনগণের প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। যেমনটা আমরা দেখেছিলাম একাত্তরে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মানুষ। তাই বিত্তবানরা তাঁকে কিনতে পারেনি, বশীভূত করতে পারেনি, তাঁর ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারেনি। এমনটা বিরল! বিত্তবানরা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কিনে ফেলে। পুরো দলই তাদের অনুগত হয়ে যায়। জনগণের বিকল্প শক্তি থাকে না। দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ক্রয়কর্ম সহজ হয় না। কখনো আবার উল্টোটাও দেখা যায়। দলের অনেক নেতাকে কেনা যায়, কিন্তু শীর্ষ নেতা এতই নির্ভীক ও নির্লোভ যে, তাঁকে কেনা যায় না। যেমন বঙ্গবন্ধুকে কেনা যায়নি। এমন শীর্ষ নেতা থাকলে অন্য নেতাদের স্খলন দলের এবং জনগণের ক্ষতি করে না। বরং তারাই ঝরে পড়ে। তবে এমন নেতৃত্ব ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চাই দলকে গণমুখী রাখতে সহায়ক।
শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং দারিদ্র্য সংকোচনের মাধ্যমে গণমানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, যা কোটারি শক্তিকে পরাভূত করতে পারে। এ ছাড়া সাধারণ নাগরিকরা মানবাধিকার সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, ইস্যুভিত্তিক সংগঠন প্রভৃতির মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে পারে। তারা সমাজের বিবেকের মতো কাজ করতে পারে। রাজনীতির শুভ অংশকে সমর্থন দিতে পারে। অশুভ অংশের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারে জনসমক্ষে। এভাবেই জনতার শক্তি সংহত হয়_সরকারে এবং বিরোধী দলে। ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে বিত্তের দাসরা। সেই বিত্ত হতে পারে দেশের ভেতরের। বলবান হতে পারে বহিঃশক্তির সংযোগে। মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান এবং পশ্চিমা বিত্তের প্ররোচনা ও উন্মাদনায় বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান এবং 'বিত্তের নির্বাচন' আমরা দেখেছি। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও বিকাশ সাধনে বিত্তের অমঙ্গল বার্তা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। ভোট নাগরিকের অধিকার। কিন্তু ভোট যখন কেনা হয়, তখন অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। নাগরিককে অপমান করা হয়।
দেশি-বিদেশি অর্থবিত্তের জিঞ্জির থেকে রাজনীতি তথা গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে পারলেই কল্যাণতন্ত্রের কথা চিন্তা করা যায়। কল্যাণতন্ত্রে বিত্তবানের বিত্ত কেড়ে নেওয়া হয় না। কেড়ে নেওয়া হয় অতিবিত্তের দুর্বৃত্তায়নকে। বিত্তবানদের কাছ থেকে কর আহরণ করে বিত্তহীন ও স্বল্পবিত্তের প্রয়োজনে তা ব্যয় করা হয়। বিত্তহীন ও স্বল্পবিত্ত নাগরিকদের ক্ষুদ্র পুঁজি গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। ক্ষুদ্র পুঁজিই একদিন বিত্তহীনকে স্বল্পবিত্তে এবং স্বল্পবিত্তকে মধ্যবিত্তে রূপান্তর করে। সমাজে বৈষম্য হ্রাস পেতে থাকে। সবাই সমান হয় না সত্যি, হাতের পাঁচটি আঙুলও সমান নয়, কিন্তু পাশাপাশি অবস্থান করে থাকে নিজ নিজ মহিমায়। ছোট-বড় হওয়ার অনুপাত দৃষ্টিকটু হয় না। এমন সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি করতে পারলেই কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়।
বাংলাদেশে দুঃসহ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশ যেন দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল_নগরদেশ ও গ্রামদেশ। জাতীয় আয়ের বেশির ভাগ ছিল নগরে। গ্রামবাংলায় জাতীয় আয়ের ভাগ ছিল অল্প পরিমাণ। ২০০৯ সালে নতুন সরকার এসে বৈষম্য কমিয়ে আনার কাজ শুরু করে। পাঁচ হাজার কোটি টাকা কৃষি ভর্তুকি দিয়ে সার, বীজ, সেচ তথা কৃষি উপাদানগুলো সহজলভ্য করে তোলে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ করে দুর্বলদের দুর্বলতা কমিয়ে আনার প্রয়াস পায়। গ্রামবাংলার চেহারা এখন কিছুটা হলেও পাল্টে গেছে। একসময় ক্ষেতে ফসল থাকতেই কৃষক অভাবের তাড়নায় নামমাত্র মূল্যে আগাম বিক্রি করে দিত। আজ সেই অবস্থা নেই। এখন ধান তোলার পরও কিছুদিন ধরে রাখার সক্ষমতা অনেক কৃষক অর্জন করেছে। কৃষকের ক্ষুদ্র পুঁজি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মাত্র। অকৃষিকর্মেও পল্লী অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে পল্লীপুঁজি গড়ে উঠলে গ্রামের লোক ঢাকায় আসবে না। বরং দুঃসহ শহুরে জীবন ছেড়ে গ্রামে ফেরার প্রবণতা সৃষ্টি হবে। এটা করতে হলে অর্থনীতির বর্তমান গতিধারাকে আরো অনেক দিন চালিয়ে নিতে হবে।
দেশি-বিদেশি বিত্তবানরা কি চেয়ে চেয়ে দেখবেন? কিছুই করবেন না? তেমন তো হয় না। তাঁরা অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করবেন, হরতাল-অরাজকতা সৃষ্টি করবেন, অর্থবিত্ত ঢেলে মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার চালাবেন, অপরাজনীতিতে ফিন্যান্স করবেন, নির্লোভ-নির্ভীক রাজনীতিকদের হেনস্তা করবেন, এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধা করবেন না। শহরে এক ধরনের মেরুদণ্ডহীন সুশীল সমাজ রয়েছে, তাদের বশে রাখবেন। গোলটেবিলে তালগোল পাকাবেন, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন।
গণতন্ত্রের পথ যেমন কুসামাস্তীর্ণ নয়, তেমনি কল্যাণতন্ত্রে উত্তরণও কণ্টকাকীর্ণ। ধনতন্ত্র থেকে কল্যাণতন্ত্রে উত্তরণ গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব। তবে শুধু গণতান্ত্রিক পথে নিশ্চিত নয়। এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ়চিত্ত, নির্লোভ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তথা রাজনৈতিক দল। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সদা সচেতন শিক্ষিত স্বাবলম্বী অতন্দ্র প্রহরী, অর্থাৎ নাগরিক সমাজ। জনগণই রাষ্ট্রের মালিক_সাংবিধানিক এই ধারণাটির উপলব্ধি ঘটাতে হবে প্রত্যেক নাগরিকের হৃদয়ে। তাহলেই ধীরে ধীরে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.