খোলা চোখে-ওবামা: এক দফার প্রেসিডেন্ট? by হাসান ফেরদৌস

আমার মনে হয়, বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে সরকার রয়েছে, তার সঙ্গে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সির এক জায়গায় মিল আছে। প্লিজ, হেসে উড়িয়ে দেবেন না, আগে আমার কথাটা শুনুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উভয়েই ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নিজ নিজ দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন।
তাঁরা দুজনই অভাবনীয় জনসমর্থনে ধন্য হয়ে নির্বাচিত হন। এর আগে দেশ যেভাবে চলছিল, উভয় দেশের মানুষই তাতে হতাশ হয়েছিল। ফলে বিপুল ভোটে তাঁদের নির্বাচন ছিল পূর্বতন শাসকদের ঢালাও প্রত্যাখ্যান। দেশকে ঢেলে সাজানোর ম্যান্ডেট তাঁরা পেয়েছেন—এ কথা সে সময় উভয়েই দাবি করেছিলেন। কম-বেশি সবাই সে কথা মেনেও নিয়েছিল। এখন আড়াই বছরের মাথায়, কেউ কেউ বলা শুরু করেছেন—হবে না, এঁদের দিয়ে হবে না।
এই মুহূর্তে যদি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার ফল কেমন হবে? শেখ হাসিনার কথা না হয় না-ই বললাম, তা আপনারা ভালোই জানেন। কিন্তু ওবামা সাহেব যে টেঁসে যাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা হয়তো এখনো খুব মন্দ নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর সমর্থনের কথা যদি ধরি, তাহলে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। গ্যালপ নামের এক সংস্থার জনমত জরিপে তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে জনসমর্থনের পরিমাণ ৪২: ৫০। এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিরোধী রিপাবলিকান দলের দুই প্রধান প্রার্থী টেক্সাসের গভর্নর রিক পেরি ও ম্যাসাচুসেটসের সাবেক গভর্নর মিট রমনি—উভয়েই তাঁকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম। বিপদ টের পেয়ে খোদ ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরে কেউ কেউ বলা শুরু করেছেন, ওবামার বদলে অন্য কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া অধিক যুক্তিসংগত হবে। আবার কেউ কেউ জিব কেটে বলছেন, এর চেয়ে হিলারি ক্লিনটন যদি প্রেসিডেন্ট হতেন, তাহলে বরং বেশি ভালো হতো।
তার মানে, বারাক ওবামা কি এক দফার প্রেসিডেন্ট বলে পরিচিত হবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। আগামী নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি। রাজনীতিতে সে প্রায় অনন্তকাল। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। কিন্তু যে কথাটা এখন দিনের মতো ফরসা তা হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা আমাদের একসময় যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, এখন তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। বাম, ডান ও মাঝের অধিকাংশই তাঁকে নিয়ে হতাশ। হতাশ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, তাঁর কাছ থেকে সবাই আশা করেছিল অনেক বেশি।
ওবামার জন্য মস্ত গেড়ো হলো অর্থনীতি। বুশের সময় থেকে অর্থনীতি সেই যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তার পরিবর্তনের কোনো সাড়াশব্দ নেই। এর জন্য সব দোষ যে ওবামার, তা নয়। ধনতন্ত্র বরাবর সাইকেলের চাকার মতো ওঠানামা করে। একসময় সেই চাকা ফের হয়তো উঠবে, কিন্তু সে জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য এ দেশের মানুষের নেই। আমেরিকার মানুষ দ্রুত ফল চায়—ওবামা সে ফল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কম চেষ্টা তিনি করেননি। ৮০০ বিলিয়ন ডলারের ‘স্টিমুলাস’ প্যাকেজ থেকে শুরু করে নতুন কর রেয়াতি পর্যন্ত হেন কাজ নেই তিনি করেননি। কোনোটাই কাজে লাগেনি। সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারত্ব নিয়ে। নতুন কর্মসংস্থান না হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা বলছে, ওবামার পরিকল্পনার গোড়াতেই গলদ ছিল। ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের যে ঋণের বোঝা আমেরিকার ঘাড়ে আছে, তা কমানোর চেষ্টার বদলে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কেবল ‘দরিয়ামে ঢেলে’ই চলেছেন। অবস্থা বদলাতে হলে অন্য কিছুর আগে ব্যয় কমাতে হবে, সে জন্য দরকার হলে পেনশনব্যবস্থা, এমনকি সোশ্যাল সিকিউরিটিব্যবস্থা পর্যন্ত ঢেলে সাজাতে হবে। রিপাবলিকানরা এ কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে অর্থনীতির খোলনলচে বদলানোর এই কাজটা ডেমোক্র্যাটদের দিয়ে হবে না, ওবামাকে দিয়েও নয়। সে কারণে গত বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদের নেতৃত্ব ডেমোক্র্যাটদের বদলে রিপাবলিকানদের হাতে চলে গেছে। ভাবা হচ্ছে, অবস্থা না বদলালে আগামী বছর সিনেট থেকেও বিদায় নেবেন ডেমোক্র্যাটরা। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো বা ওবামাও।
তার মানে আমও যাবে, ছালাও।
ওবামা নিজে রিপাবলিকানদের প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে আপস চুক্তির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, গোড়াতে নানা শক্ত কথা বলে মাঠ গরম করবেন তিনি, কিন্তু রিপাবলিকানরা যে-ই তাঁর মুখের ওপর দরজা সেঁটে দেয়, অমনি তাঁর সুরও বদলে যায়। রিপাবলিকানরা বুঝে গেছে, তারা যদি একজোট হয়ে থাকতে পারে, ওবামাকে কোণঠাসা করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। গত দুই বছরে এ কথার প্রমাণ বারবার মিলেছে। দেশের প্রেসিডেন্সি ডেমোক্র্যাটদের হাতে, কংগ্রেসের অর্ধেক ডেমোক্র্যাটদের হাতে। অথচ রিপাবলিকানরা যা খুশি বলছে, কিছুটা গাঁইগুঁই করার পর ওবামা তাদের সে কথাই মেনে নিচ্ছেন।
যেমন ধরুন স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে মস্ত সব লম্বা লম্বা কথা শোনা গেল, অথচ রিপাবলিকানদের বিরোধিতার মুখে যে আইন পাস হলো, তাতে স্বাস্থ্যবিমা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার যে কথা ওবামা বারবার বলেছিলেন, সেটাই বাতিল হলো। বুশের আমলে ধনীদের জন্য যে কর রেয়াতি ছিল, গত ডিসেম্বরে তার মেয়াদ শেষ হয়। ওবামা পই পই করে বলেছিলেন, এই রেয়াতি তিনি আর বাড়াবেন না। রিপাবলিকানরা দাবি তুলল, এই কর রেয়াতির মেয়াদ না বাড়ালে নিম্নবিত্তদের জন্য কর রেয়াতি ও বেকার-ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব তারা মানবে না। ধনীদের জন্য ওই কর রেয়াতি বাতিল করলে আমেরিকার ঋণসমস্যা রাতারাতি মিটে যায়—সে কথাটা দেশের মানুষকে বোঝানো গেলে রিপাবলিকানরা নির্ঘাত পিছু হটত। কিন্তু সে পথে না গিয়ে রিপাবলিকানদের দাবিই মেনে নিলেন ওবামা। আমেরিকা কী পরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে ধার করে দেশ চালাতে পারে, তা নিয়ে মাস দুই আগে এক মস্ত নাটক হয়ে গেল। সময়মতো ধারের পরিমাণ না বাড়ালে আমেরিকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। সে কথা জেনেও রিপাবলিকানরা গোঁ ধরে বসে ছিল, সরকারি ব্যয় বিপুল পরিমাণে হ্রাস করা না হলে তারা ‘ঋণসীমা’ বাড়াতে সম্মত হবে না। দেশের অর্থনীতি যখন ক্রমসংকোচনের মুখে, সে সময় সরকারি ব্যয় হ্রাসের ফল ভালো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ওবামা রিপাবলিকানদের যুক্তিই মেনে নিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত যে আইন পাস হলো তা দেখে রিপাবলিকান স্পিকার জন বেইনার বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমরা যা চেয়েছিলাম, তার ৯০ শতাংশই আদায় করে নিয়েছি।’
কত সহজে কোনো লড়াই ছাড়া ওবামা চাপের মুখে হার মানেন, তার আরও এক উদাহরণ পাওয়া গেল গত সপ্তাহে। ওবামা বরাবর নিজেকে পরিবেশবান্ধব প্রেসিডেন্ট বলে পরিচয়ে আগ্রহী। সবাই আশা করেছিল, ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে তিনি শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের একটি প্রস্তাব চূড়ান্তও করা হয়েছিল। গত সপ্তাহে জানা গেল, ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে ওবামা সে প্রস্তাব বাতিল করেছেন। যুক্তি দেখানো হয়েছে, দেশের অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থায় বায়ু নিয়ন্ত্রণের কড়া নিয়মকানুন চালু করা হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। অতএব, তাঁর সিদ্ধান্ত, বুশ আমলের যে কম কঠোর (আসলে পরিবেশ-প্রতিকূল) আইন চালু ছিল, আপাতত তা-ই বহাল থাকবে। বলা বাহুল্য, এ সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছে আমেরিকার পরিবেশবাদীরা। সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেসের একজন মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন, ওবামা প্রশাসন আবারও ব্যবসায়ী লবি ও রিপাবলিকানদের চাপে হার মানল।
সত্যি বলতে কী, যে দ্রুততার সঙ্গে ওবামা অপর পক্ষের দাবি মেনে নিচ্ছেন, তা দেখে মনে হয়, এই লোকটা বোধ হয় আগামী নির্বাচন ডেমোক্র্যাট হিসেবে নয়, রিপাবলিকানদের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মারকুটে ভাষ্যকার এজরা ক্লাইন তো বলেই বসেছেন, ওবামা আসলে ডেমোক্র্যাটের পোশাক পরা একজন মধ্যপন্থী রিপাবলিকান। যাঁরা এখনো ওবামার ওপর আস্থা পুরোপুরি হারাননি, তাঁদের জন্য সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক হচ্ছে রিপাবলিকানদের সঙ্গে আপসে তাঁর অতি আগ্রহ। তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট, স্পষ্ট ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ তাঁর প্রেসিডেন্সির এজেন্ডা তৈরি হচ্ছে রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের মুখ চেয়ে। সর্বশেষ যা ঘটেছে, তা রীতিমতো হাস্যকর। ওবামা জানিয়েছিলেন, কংগ্রেসের উভয় কক্ষের এক যৌথ সভায় তিনি নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখবেন। ৭ সেপ্টেম্বর সে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি যথারীতি স্পিকার বেইনারকে চিঠিও দিয়েছিলেন। বেইনার পাল্টা এক চিঠিতে জানিয়ে দেন, প্রেসিডেন্টের অনুরোধ রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, ঠিক সেদিন ওই সময় রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা তাঁদের নিজেদের মধ্যে এক বিতর্কে মিলিত হবেন। তবে তিনি চাইলে পরদিন, অর্থাৎ ৮ সেপ্টেম্বর সে ভাষণ দিতে পারেন। ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম আমেরিকার কংগ্রেস দেশের প্রেসিডেন্টকে এভাবে পত্রপাঠ ‘না’ করে দিল। এর চেয়ে সপাট একখান চড় দিলেও বোধ হয় কম অপমানজনক হতো। মিনমিনে ওবামা ‘তথাস্তু’ বলে সে সিদ্ধান্তই মেনে নিয়েছেন।
কিছুটা রাগে, কিছুটা দুঃখে উদারনৈতিক ভাষ্যকার মাইকেল টমাস্কি লিখেছেন, ‘অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে খুব শিগগির ওবামাকে আমরা কেউ নেতা হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে আর নেব না।’ আরেক উদারনৈতিক ভাষ্যকার ম্যাট মিলার বলেছেন, ‘ওবামা নামের মানে হলো পরাস্ত, হাত গুটানো, নুয়ে পড়া, মেনে নেওয়া, আত্মসমর্পণ, বিনা প্রতিবাদে সম্মত হওয়া। এককথায় এক হতোদ্যম ও পরাজিত মানুষ। আগামী নির্বাচনের আগেই যদি ওবামা পরাজয় মেনে নেন, তাহলে দ্বিতীয় দফা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো যুক্তি থাকে কি?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.