জনস্বার্থে গ্যাস-কয়লা রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন দরকার by ড. এম শামসুল আলম

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের খনিজ সম্পদ অর্থাৎ তেল, গ্যাস, কয়লার মতো জ্বালানি সম্পদের মালিক জনগণ। গত শতাব্দীর শেষ দশকে ভারতে গ্যাস রপ্তানির প্রচেষ্টায় সে মালিকানা তথা জনগণের এই সাংবিধানিক অধিকার হুমকির সম্মুখীন হয়।


এ পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সালে জ্বালানি সম্পদ রক্ষার্থে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির নেতৃত্বে দল-মতনির্বিশেষে দেশের সচেতন মানুষ সংগঠিত হয় এবং আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে বিবিয়ানার গ্যাস ভারতে রপ্তানির উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। আবার বিদেশি কম্পানির মালিকানায় রপ্তানির উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উত্তোলনের চেষ্টা এবং সে অর্থে কয়লানীতি প্রণয়নের তৎপরতাও এই জাতীয় কমিটির আন্দোলনের কারণে
ব্যর্থ হয়।
সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ চায়। তাই সে বিনিয়োগ আকর্ষণে গ্যাস ও কয়লা খাত উন্নয়নে গৃহীত নীতিমালায় গ্যাস ও কয়লা রপ্তানির সুযোগ রাখার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগে পিএসসির আওতায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন চলছে। সে গ্যাস বিদেশি বিনিয়োগকারীর মালিকানায় বিদেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে এ গ্যাস সরকার ব্যতীত অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে সরাসরি বিক্রির সুযোগও এ বিনিয়োগকারী পাচ্ছে। বছরে উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী কম্পানি খরচ উসুল বাবদ পেতে পারে। বাদবাকি ৪৫ শতাংশের অর্ধেক অর্থাৎ ২২.৫ শতাংশ নিজস্ব হিস্যা হিসেবে পাবে বিদেশি কম্পানি। সরকার নিজের অংশ হিসেবে পাবে বাদবাকি অর্ধেক অর্থাৎ ২২.৫ শতাংশ। এই হিসাবে উৎপাদিত গ্যাসের ৭৭.৫ শতাংশের মালিক হতে পারে বিদেশি কম্পানি। এই গ্যাস বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের কাছে বিক্রি করার বিধান থাকলেই সরকার এ গ্যাস কিনবে এবং উৎপাদিত গ্যাসে জনগণের শতভাগ মালিকানা সংবিধানের আলোকে নিশ্চিত হবে। অথচ বিদেশি কম্পানির মালিকানাধীন ওই গ্যাস তার নিজস্ব মালিকানায় সরকার ব্যতীত অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি কিংবা বিদেশে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হলে সে গ্যাসের মালিকানা থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়। এ অবস্থা সংবিধানের পরিপন্থী এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিদেশি বিনিয়োগে কয়লা খাতের উন্নয়ন সেই পরিস্থিতির শিকার। বিদ্যমান আইন ও বিধান অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগে যদি কয়লা তোলা হয়, তাহলে রয়্যালটি হিসেবে সরকার পাবে সে কয়লার ৬ শতাংশ বা তার সমতুল্য বাজার মূল্য। বাদবাকি ৯৪ শতাংশ কয়লা পাবে বিদেশি বিনিয়োগকারী কম্পানি। যদি কয়লার পরিবর্তে কয়লার বাজার মূল্যে বিনিয়োগকারী মুদ্রায় রয়্যালটি পরিশোধ করে, তাহলে উৎপাদিত সমুদয় অর্থাৎ শতভাগ কয়লার মালিক হবে বিদেশি কম্পানি। কম্পানির পাওয়া এই সমুদয় কয়লা সরকারের কাছে সরাসরি বাধ্যতামূলকভাবে বিক্রির আইন বা বিধান থাকলেই কয়লার ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত হয়। অথচ এমন আইন বা বিধান না থাকায় উৎপাদিত শতভাগ কয়লার মালিক হতে পারে বিদেশি কম্পানি। সেই কয়লা নিজস্ব মালিকানায় সরকারের পরিবর্তে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারে বা বিদেশে রপ্তানি করতে পারে। ফলে গ্যাসের অনুরূপ এই কয়লা সম্পদের মালিকানা থেকেও জনগণকে বঞ্চিত হতে হবে। এ অবস্থাও সংবিধানের পরিপন্থী এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের ব্যাপারে কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে পিএসসি সম্পাদিত হচ্ছে। এই পিএসসির আওতায় উৎপাদিত গ্যাস বিদেশি বিনিয়োগকারীর নিজস্ব মালিকানায় এলএনজি হিসেবে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সরকার ব্যতীত তৃতীয় পক্ষের কাছে এই গ্যাস সরাসরি বিক্রির সুযোগও বিনিয়োগকারীর রয়েছে। ইতিমধ্যে হেলিবার্টন ও সান্টোসকে তৃতীয় পক্ষের কাছে তার মালিকানাধীন গ্যাস বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার কয়লা তোলার ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত খনি ও কয়লা রপ্তানির সুযোগ রেখে কয়লানীতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তা এখন সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়। অন্যদিকে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ বিল প্রক্রিয়াধীন। অথচ এর কোনো অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় জ্বালানি সম্পদ গ্যাস ও কয়লার ওপর জনগণের মালিকানার মতো মৌলিক অধিকার এখন খর্ব হতে চলেছে। জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীকে কর ও শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয় যেন তুলনামূলক কম দামে সরকার গ্যাস কিংবা কয়লা পেতে পারে। দেশীয় উৎপাদনে সে গ্যাস বা কয়লা কম দামে সরবরাহ করে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারে। ফলে জনগণ কম দামে সে পণ্য কেনার সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে সে গ্যাস ও কয়লা যদি বিদেশি বিনিয়োগকারী তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি কিংবা বিদেশে রপ্তানির সুযোগ গ্রহণ করে, তাহলে জ্বালানির সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে এবং উৎপাদিত পণ্য তখন জনগণকে অধিক দামে কিনতে হয়। ফলে জনগণ বঞ্চনার শিকার হয়। এ অবস্থায় জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব হয়। এ অবস্থা সংবিধানের পরিপন্থী এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ পরিস্থিতি থেকে জনগণের অধিকার ও জনস্বার্থ রক্ষার জন্য কেবল দরকার খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ বিল জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হয়ে আইনে পরিণত হওয়া।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। জনশ্রুতি রয়েছে, এ সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারী ইউনোকলের প্রস্তাবে ভারতে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি না হওয়ায় বিদেশি কম্পানির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে সে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে জনগণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। সুতরাং এ সরকারের হাতে খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন হবে এবং গ্যাস ও কয়লা রপ্তানির সুযোগ রহিত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীর মালিকানাধীন গ্যাস কিংবা কয়লা সরকারের কাছে বিক্রি করা বাধ্যতামূলক হবে। কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে এ গ্যাস কিংবা কয়লা বিক্রির কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে জ্বালানি সম্পদের ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানা অটুট থাকবে। এ জন্য দরকার গণ-আন্দোলন। সে আন্দোলন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হয়েছে। দল-মতনির্বিশেষে দেশের সব মানুষ গ্যাস ও কয়লা রপ্তানির বিরুদ্ধে এবং এ সম্পদের ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানার নিশ্চয়তা চায়। তাই তেল-গ্যাস-কয়লা রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন চায়। জনসচেতনতাই এই দাবির পথ আরো প্রশস্ত করতে পারে এবং জন-আন্দোলন দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থ রক্ষা করবে। প্রক্রিয়াধীন বিলটি একদিন সংসদে উপস্থাপন হবে এবং তা আইনে পরিণত হয়ে গ্যাস ও কয়লার মতো জ্বালানি সম্পদে জনগণের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করবে_এমন প্রত্যাশায়
এ লেখা।

লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.