ঘুষ-দুর্নীতির শিক্ষা ভবন-দূর করতে হবে এই অনাচার

শিক্ষা ভবন যে ঘুষ-দুর্নীতির 'সেফ হোম', তা বোধ হয় নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘুষ যেমন এখানে স্বীকৃত একটি ব্যাপার, তেমনি দুর্নীতিও যেন 'প্রাতিষ্ঠানিক রূপ' পেয়েছে শিক্ষা ভবনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি এবং শিক্ষকদের পরবর্তী গ্রেড পাওয়া থেকে শুরু করে বদলি, পদোন্নতি, টাইম স্কেল_সব কিছুর সঙ্গে ঘুষের গভীর যোগ।


অন্যদিকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতি। শিক্ষাক্ষেত্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে শিক্ষা ভবন নামের ভবনটিই যথেষ্ট। গতকাল বুধবারের কালের কণ্ঠ এবং সহযোগী একটি দৈনিকে শিক্ষা ভবনের ঘুষ-দুর্নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা ভবনের ঘুষ-দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে দুই প্রতিবেদনে।
'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড'_এই আপ্তবাক্যটি সবারই জানা। কিন্তু সেই মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্ব যে শিক্ষকদের, তাঁদের মেরুদণ্ড বাঁকা করে দিতে পারে শিক্ষা ভবন। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ভবনটি ঘুষ-দুর্নীতির আখড়া হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। এই ভবনটি ঘিরে অনেক অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা জানেন, ঘুষ ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের এখানে প্রতিদিন হেনস্তা হতে হয়, ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কোনো কাজ করাতে এই ভবনে এলে ঘুষ দেওয়াটা যেন বাধ্যতামূলক। আর ঘুষ নেওয়াটা যেন এখানকার রীতিতে পরিণত হয়েছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এখানে বিভিন্ন কাজে আসেন। সেই কাজের জন্য সঙ্গে আনতে হয় ঘুষ। একেক কাজের ঘুষের পরিমাণ আলাদা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, পরবর্তী গ্রেডে পদায়ন, বদলি ইত্যাদি বিষয়ে ঘুষের অঙ্ক আলাদা আলাদা। তেমনি ঘুষ নেওয়ার জন্য আলাদা লোক ঠিক করা আছে। আছে এক শ্রেণীর দালাল। এখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও একদিন কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু এই ভবনে কাজ করতে এসে সেই সময়কার কথা যেন সবাই ভুলে যান। যে শিক্ষক পরম যত্নে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করেন, তৈরি করেন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক, তাঁর ভবিষ্যৎ হয়তো নির্ভর করে শিক্ষা ভবনে দেওয়া ঘুষের ওপর। এখানে ঘুষ না দিলে হারিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট ফাইল। ঘুষ দিলে নিখোঁজ ফাইল যেন জাদুমন্ত্রবলে এসে হাজির হয়ে যায়। একই অবস্থা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরেও। সেখানেও বাসা বেঁধেছে ঘুষ-দুর্নীতি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঘুষ ছাড়া সেখানে যেমন কোনো কাজ হয় না, তেমনি এমন কোনো কাজ নেই, যে ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয় না। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু এই নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দুর্নীতি করা হয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন সবার বিরুদ্ধেই ঘোরতর দুর্নীতির অভিযোগ।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই জাতির বিবেক বিকশিত হয়। একজন শিক্ষকের হাত ধরে বেড়ে ওঠে দেশের ভবিষ্যতের নাগরিক। কিন্তু সেই শিক্ষককে যদি দুর্নীতির শিকার হতে হয়, ঘুষ দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে তিনি কিভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন আগামী দিনের নাগরিক? এ অবস্থা চলতে থাকলে তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলে গর্ব করার মতো কিছুই থাকবে না আমাদের। শিক্ষকতার মহান পেশাকে কলুষিত এবং তার মান-মর্যাদাকে যাঁরা এভাবে ভূলুণ্ঠিত করছেন, তাঁরা কার্যত জাতির ভাবমূর্তিকেই কালিমালিপ্ত করছেন। তাঁদের বিবেক ও আত্মপরিচয় জাগ্রত হোক, শিক্ষকতার আদর্শ সমুন্নত থাকুক_এটাই আমাদের ঐকান্তিক কামনা। শিক্ষা ভবন থেকে ঘুষ-দুর্নীতি যেকোনো মূল্যে দূর করতেই হবে। দূর করতে হবে সব ধরনের অনাচার। শিক্ষকদের মুক্ত মনে শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ করে দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.