আলোকের এই ধরনাধারায় (পর্ব-২৯)-হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল by আলী যাকের

বাবার মৃত্যুর পর আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার আকস্মিক রূপান্তরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমার বিধবা মা। যেসব জাগতিক বিষয়ে আমরা অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তা তিনি পূরণ করেছিলেন তাঁর ভালোবাসা দিয়ে।


প্রায় মাতৃরূপী মুরগির মতোই তিনি তাঁর দুই ডানা দিয়ে আগলে রাখতেন এবং বুকের মাঝে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তাঁর নিজের স্বাস্থ্যও তখন খুব একটা ভালো নয়। তবে আমাদের কাউকে তিনি তা বুঝতে দেননি। দোতলায় ওই দুই রুমের বাসায় আমরা একে অন্যের সানি্নধ্য আরো ঘনিষ্ঠভাবে পেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যখনই আমরা একসঙ্গে থাকতাম, আমাদের ভুবন অত্যন্ত আনন্দময় হয়ে উঠত। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকায় সব সময় আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেননি। ওইসব পারিবারিক আসরের মধ্যমণি ছিলেন দিদি। আমার বোনাই তখন আমেরিকায় এমএস করছিলেন। ফলে স্বামীর সংসারে দিদির তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না। তত দিনে দিদির চারটি সন্তানের জন্ম হয়ে গেছে। এরাও আমাদের সঙ্গে একই পরিবারভুক্ত মানুষ হিসেবে মিলেমিশে দিন কাটাত। আমি আগেই বলেছি যে বাবার মৃত্যুর পর তাঁর এবং মায়ের বন্ধুবান্ধবরা আমাদের প্রতিনিয়ত সাহচর্য দিয়েছেন এবং আমাদের শোক লাঘব করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা এবং পাড়ার অন্য শুভার্থীরা আমাদের আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। শুরু হলো মুকুল মেলার কর্মকাণ্ড। সাহিত্যচর্চা এবং আমাদের নিজস্ব পড়াশোনা। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ভাইয়ার স্নাতক পরীক্ষা হয়ে গেল। তিনি পূর্ব পাকিস্তান টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউট থেকে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে বিএসসি টেক. পাস করলেন। শোকের সব বেদনাবহ ধাক্কা কাটিয়ে যখন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম, তখন আমার মা আর নিজের অসুস্থতাকে চেপে রাখতে পারলেন না। একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন এবং তাঁর জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়ল। ১৯৬২-তে আমি নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। ১৯৬১-তে অকস্মাৎ বাবা মারা যাওয়ার যে আঘাত, সেটা তখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কেমন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। এরই মধ্যে মায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার খবর কেমন যেন স্তম্ভিত করে দিল আমাকে। তখনো অবশ্য ক্যান্সার রোগটি সম্বন্ধে বিস্তারিত কোনো ধারণা ছিল না আমার। কেবল জানতাম, ওই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মাকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো আমাদের। বাষট্টির ওই সময়ের মধ্যে মা আমাদের পিতৃহীন সংসারকে বেশ গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের অভাব-অনটন যেন আমাদের জীবনকে কোনোভাবেই প্রভাবিত না করে, সে সম্বন্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সজাগ। আমাদের ভাড়াটেরা আমাদের সহায়তা করলেন চিকিৎসার খরচাপাতি সংগ্রহ করতে অগ্রিম ভাড়া দিয়ে। আমাদের বলা হয়েছিল, দীর্ঘদিনের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে মায়ের।
এই সময় আমার বন্ধুবান্ধবরা, বিশেষ করে মুকুল মেলার মাধ্যমে যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হয়েছিল, তাদের আন্তরিক সমবেদনায় আমরা সত্যিই বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। মুকুল মেলার সুজাত, দেওয়ান, বজু ভাই, মওলা ভাই_এঁরা সবাই নিত্য আমাদের খোঁজখবর নিতেন এবং সব ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। বাষট্টির জুন মাসে আমরা মাকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মায়ের ইচ্ছা ঢাকা থেকে নদীপথে খুলনা যাওয়ার। সেখানে আমার মেজ মামা থাকতেন। তাঁর বাড়িতে কয়েক দিন কাটিয়ে, রেলপথে বেনাপোল-বনগাঁ হয়ে কলকাতা যাওয়ার ইচ্ছা ছিল মায়ের। তখন ভাইয়া সদ্য (চওঅ) পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসে চাকরি নিয়ে তাদের যশোর অফিসে যোগ দিয়েছেন। বিএসসি টেঙ্টাইল পাস করে আমার বড় ভাইয়ের এয়ারলাইনসে চাকরি নেওয়ার পেছনে একটা ইতিহাস আছে। প্রসঙ্গত তার উল্লেখ প্রয়োজন বলে মনে করি।
ভাইয়া টেঙ্টাইল পাস করার পর ঢাকার অদূরে একটি সুবৃহৎ বস্ত্র কারখানায় ইন্টার্নশিপ করছিলেন। সেই সময় ওই কারখানার ভেতরে ভেসে বেড়ানো তুলা তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করে এবং তিনি বেশ কিছুদিন শ্বাসকষ্টে ভোগেন। সেই থেকে তিনি টেঙ্টাইল মিলে কাজ করার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। অবশেষে তিনি লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ দিয়ে পিআইএতে যোগ দেন। করাচিতে পিআইএর হেড অফিসে কিছুদিন হাতে-কলমে কাজ শেখার পর তাঁর পোস্টিং হয় সেলস্ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যশোরে। আমার এখনো মনে আছে, ভাইয়াকে তাঁর চাকরির সুবাদে ইউনিফর্ম পরতে হতো। এবং তিনি সেই পোশাক ভীষণ পছন্দ করতেন। আমরা দিন চার-পাঁচেক খুলনায় মেজ মামার বাড়িতে কাটিয়ে একদিন সকালে কলকাতা রওনা হলাম। ভাইয়াকে আগে থেকেই বলা ছিল যে আমরা ওই ট্রেনে যশোর-বেনাপোল হয়ে কলকাতা যাচ্ছি। যথাসময়ে ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশ করল। আমরা একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় ছিলাম। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া ইউনিফর্মের স্যুট-টাই এবং ক্যাপ পরে আমাদের জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাকে খটাস করে একটা স্যালুট করলেন। তারপর উঠে এলেন কামরায়। মা ভাইয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। গাড়িতে আমরা সবাই ছিলাম_দিদি, আমি, আমার ছোট বোন ঝুনু। মনে পড়ে, বেশ কিছুক্ষণ সময় যশোরে ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। গোটা সময়টা ভাইয়া আমাদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা ও গল্পে মেতে রইলেন। তারপর হুইসল দিয়ে ট্রেন চলা শুরু করার পর ভাইয়া কামরা থেকে নেমে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি মায়ের দৃষ্টির দিকে নিবদ্ধ। ভাইয়ার চোখে তখন জল চিক্ চিক্ করছে।
(চলবে....)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.