সামাজিক অনাচার, শিক্ষাব্যবস্থা ও পারিবারিক বন্ধন by ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

দেশে আজ সামাজিক সহনশীলতার অভাব প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ দেশে দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটায় সামাজিক অস্থিরতা ও অসংগতি প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। সমাজব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি শাসনক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টায় রতরা নিজেদের আখের গোছাতে সক্ষম হলেও দরিদ্র শ্রেণী সুবিধাবঞ্চিত হয়ে অস্থির সমাজব্যবস্থায় নিগৃহীত হচ্ছে। ফলে সামাজিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্ত হচ্ছে না।


সামষ্টিক চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে_এই ভারসাম্যহীনতা সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। তবে গত ৪০ বছরে দারিদ্র্যের হার কমলেও দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমেনি। ইভ টিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধির হীন চক্রান্তের শিকার হয়ে অনেক মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এই ব্যাধির কবল থেকে মুক্তির জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা যথাযথ ভূমিকা পালন করছেন না। আসলে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেমেয়ে, দুই পক্ষের জন্যই প্রতিটি পরিবার থেকে বিশেষ সহমর্মিতা থাকা প্রয়োজন। যদিও বখাটেদের কারণে কিছুসংখ্যক মেয়ে আত্মহনন করছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়, তা কিন্তু না-ও ঘটতে পারত। তা যদি পরিবার থেকে একতরফা ওই মেয়েকে দোষারোপ করা না হতো। অনেকে আবার একতরফা ছেলেদের দোষারোপ করছেন।
একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করছি। ছেলে 'এ' লেভেলে পড়ে। ছেলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা দুটি কাজ করেছেন_একটি হলো ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন এবং ছেলে কখন কোথায় কার কাছে যায়, তা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজের ভিড়ে খবর রাখতে চেষ্টা করেন। হঠাৎ রাতে ফিরে খেয়াল করলেন, ছেলের মন ভীষণ খারাপ। ছেলেকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন একজন মেয়ে তাকে ডিস্টার্ব করছে। ভদ্রলোক ছেলের কাছ থেকে ফোন নম্বরটি নিলেন এবং পরের দিন সকাল থেকে ট্রাই করতে করতে দুপুরের দিকে মেয়েকে মোবাইলে পেলেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলে অবাক হয়ে গেলেন, দেশেরই একটি নামকরা বেসরকারি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী। মেয়েকে বললেন, তিনি ওই মেয়ের গার্জিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে চান এবং জানতে চাইলেন, কিভাবে তাঁর ছেলের মোবাইল নম্বর পেয়েছে। মেয়ে বলল, তারা প্রায়ই বিভিন্ন মোবাইলে ফোন করে ছেলেদের এ ধরনের কথা বলে এবং নম্বর টিপতে টিপতে একসময় পেয়ে গেছে। একই সঙ্গে জানাল, এটি তার বান্ধবীদের জন্য এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের ব্যবহার তাদের এ ধরনের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ভদ্রলোক তখন মেয়েকে বললেন, তোমার মা-বাবা এবং সমাজ তোমার ওপর নির্ভর করে আছে। মেয়ে বলল, মা-বাবা না হয় নির্ভর করে আছে, কিন্তু সমাজ কেন তার ওপর নির্ভর করবে, কেননা সমাজ কখনো তাকে কিছু দেয়নি। বিস্মিত ভদ্রলোক যখন বললেন, সমাজের জন্যই, এ দেশের জন্যই সুনাগরিক হওয়া দরকার। তখন মেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, এ গরিব দেশে থেকে কী হবে? ভদ্রলোক মেয়ের পাল্টা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন। শুধু মেয়ের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন আর কখনো তার ছেলেকে ডিস্টার্ব করবে না। আসলে এককভাবে ইভ টিজিং করে বখাটেরা পার পেয়ে যাচ্ছে_কোনো মেয়ে করলেও তার ক্ষেত্রেও শাস্তি থাকা উচিত। একজন সমাজবিজ্ঞানের চর্চাকারী এবং অধ্যাপনার সূত্রে দেখা গেছে, মুষ্টিমেয় ছেলেমেয়ের জন্য এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভালো থাকতে চাওয়া ছেলেমেয়ের সমস্যা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ড. জিয়াউল হক বাংলাদেশে কিছুদিন থেকে যাওয়ার সময় তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বললেন, অস্ট্রেলিয়ায় যারা ভালো থাকতে চায় তাদের কেউ ডিস্টার্ব করে না এবং যারা খারাপ হতে চায়, তাদের খারাপ হতেও কোনো বাধা নেই। ওই ভদ্রলোক বাংলাদেশের দুটি নাইটক্লাবে তাঁর গবেষণার কাজ হিসেবে পরিদর্শন শেষে মন্তব্য করেন_ অস্ট্রেলিয়াতেও এত বেশি উচ্চকিত এবং উদ্দামতা খুব কম স্থানেই ঘটে থাকে। বাংলাদেশের কেউ কেউ এ ধরনের কাজে অধিকতর পারঙ্গম। অন্যদিকে দেশে তথাকথিত আরব দেশীয়দের অনুকরণে পোশাক-পরিচ্ছদ পরা মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। মা-বাবা দুজনই একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ডাক্তার_১০ বছর বয়সের মেয়েকে সারাক্ষণ হিজাব পরান। আমরা সবাই রহিম বাদশাহ, সোনাভানের গল্প রূপগল্প হিসেবে ছেলেবেলায় পড়েছি এবং সেভাবেই জানি। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রায়ই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যেভাবে নানা হরর বা উচ্ছৃঙ্খলতা দেখানো হয় তা কিন্তু আদৌ সন্তোষজনক এবং বাস্তবসম্মত নয়। এর ফলে ওইসব অনুষ্ঠান দেখে ছেলেমেয়েরা এটিকে সত্য বলে ধরে নেয়। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞান, মেধা-মননের শ্রেষ্ঠ চর্চা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। ভুলে যায় যে আমাদের দেশের মেধা-মনন কোনো অংশে কম নয়। মাঝখান থেকে অনেক প্রতিভাবান এ দেশে অকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
সমাজ কিভাবে সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে, তা নির্ভর করে রাজনীতিবিদদের ওপর। রাজনীতিবিদরা সমাজ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার রূপরেখা দেবেন। আর সেই রূপরেখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেহেতু যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে পড়েছে এবং বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষেত্রে মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী, সে ক্ষেত্রে তাদের কর্মক্ষেত্র থেকেই মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নেন। বন্ধু-বান্ধব ও তাদের পরিবার সম্পর্কে জানা, দিন শেষে রাতে একসঙ্গে ডিনার করা এবং ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে নেওয়া, তাদের সমস্যা, ভালো লাগা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। পারিবারিক বন্ধন যদি শক্ত হয়, মা-বাবা যদি ছেলেমেয়ের বন্ধু হতে পারেন তবে নির্ভরতা বাড়বে এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতার জন্যই ভুল বোঝাবুঝি কমে যাবে। পরিবারই হচ্ছে সামাজিক সহনশীলতা ও নৈতিকতা সৃষ্টির মূল ভিত্তিভূমি। এর পরই আসে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশালত্বের কারণে সম্ভব না হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ও স্কুলগুলোতে নূ্যনপক্ষে একজন করে মনোবিজ্ঞানী রাখা উচিত। সেই মনোবিজ্ঞানীর কাজ হবে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক বিকাশ গঠনে সহায়তা দেওয়া এবং মানসিক সমস্যা দূরীকরণে কাজ করা। একই সঙ্গে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন প্রক্টরিয়াল বডি থাকে, তেমনি কলেজ, হাই স্কুল এবং প্রাইমারি স্কুলগুলোতেও প্রক্টরিয়াল বডি থাকা খুব দরকার। এই প্রক্টরিয়াল বডির কার্যক্রম খুবই শক্ত হওয়া দরকার, যাতে কোনো ছাত্রছাত্রী বিপথগামী না হতে পারে। পারিবারিক বন্ধন অটুট থাকলে এ কাজ অনেকটা সহজ হয়। কিন্তু তার পরও এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বেড়ে উঠতে পারে যথাযথভাবে সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে এক গাদা বই চাপিয়ে দেওয়াও অনুচিত। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিই। এইচএসসিতে ১০টি কিংবা অপশনালসহ ১২টি পেপার পরীক্ষা দিতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। আগের মতো সংস্কৃতিচর্চা করারও সুযোগ পায় না। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করতে না পারায় মেধা-মননের সঠিক স্ফুরণ ও বিকাশ ঘটে না। অথচ ইংরেজি মিডিয়ামে যারা পড়ে, তাদের ক্ষেত্রে 'ও' লেভেলে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পাঁচটি সাবজেক্ট ও পেপার হিসেবে ৯-১০টি এবং 'এ' লেভেলে দুটি সাবজেক্ট ও পেপার হিসেবে ১২-১৩টি করলে চলে। আমাদের দেশে পড়ার নামে বিশাল সিলেবাসসহ যে বাড়তি চাপ দেওয়া হয়, তার জন্যই কোচিং ব্যবসা জমে উঠেছে।
সামাজিক অনাচার ও অসংগতির আরেকটি কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা না গেলে দেশে ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়বে এবং সামাজিক অব্যবস্থা থাকবে। জানি, আমরা দরিদ্র জাতি। গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য থাকলেও ক্রয়ক্ষমতা কম এবং কাজ করলেও বেতন ঠিকমতো পায় না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা করেছে, তাতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করতে চেয়েছে। এটি অত্যন্ত ভালো কাজ। এ ব্যবস্থা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষার ওপর অধিক জোর দেওয়া দরকার ছিল। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যার অধিক বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা অনেক শুভ উদ্যোগই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এদিকে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি, নির্দিষ্ট সময়ে বেতন না পাওয়ায় যে ধরনের সংঘাত হয় এটি মোটেই কাম্য নয়। আবার ইতিহাস বিকৃত করে একশ্রেণীর বামরা যেভাবে উপজাতিদের আদিবাসী বলে দাবি করে, তা মোটেই রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ নয়।
বাংলাদেশে যে ধরনের সামাজিক অনাচার, অসংগতি চলছে তা দূর হওয়া বাঞ্ছনীয়। সম্প্রতি সরকার যেখানে ঢাকা শহরে সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা নির্ধারণ করেছে, তা বেসরকারি ও সরকারি বাস মালিকরা অথবা তাদের লোকরা মানছেন না। তারা সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা আদায় করছে। গত ২০ মে কাউন্টারে ২০ টাকা চাইলে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিবাদ জানালে বনানীর দিবানিশি কাউন্টারের লোকজন মারধর করে তার দুই হাত ভেঙে দেয় এবং তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। পুলিশ তেমন কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে নীরব থাকে। আবার লিমন আহত হওয়ার পর যেভাবে বিষয়টি ঘোলাটে করা হয়েছে, তা মোটেই কাম্য নয়। মানবিকতাবিহীন সমাজব্যবস্থা চলতে পারে না। সামাজিক অনাচার বন্ধ করতে হলে অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। বিএনপি এ ব্যাপারে যে নষ্টামির যাত্রা শুরু করেছিল, তা আজ সারা দেশে সরকার সৃষ্টি করেছে। বস্তুত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সঠিকভাবে গণতন্ত্রচর্চার কোনো বিকল্প নেই। অন্যায়কে অন্যায় বলাই সংগত। বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে শান্তি, সৌহার্দ্যের সঙ্গে এ দেশে বসবাস করে আসছে। নানা সময়ে সামাজিক সুবিধা আদায়ের জন্য একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী পানি ঘোলা করতে চেয়েছে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং গত বিএনপির আমলে জঙ্গি উত্থান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং সর্বোপরি জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা ও কারাগারে পঁচাত্তরে জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ড সামাজিক অনাচারকে বৃদ্ধি করেছে এবং সমাজকে কলুষিত করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা অবিলম্বে প্রয়োজন। একই সঙ্গে সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া দরকার। সামাজিক অনাচার দূর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.