যেখানে আমাদের আশা-ভরসা by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের 'অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভারত বনাম চীন' শিরোনামে একটি লেখা কয়েক দিন আগে পড়লাম বহুল প্রচারিত একটি বাংলা দৈনিকে। বস্তুত এটি বিদেশি একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত লেখার বঙ্গানুবাদ। লেখাটি অত্যন্ত মূল্যবান এবং তথ্যসমৃদ্ধ।


বর্তমান বিশ্বে চীন এবং ভারত অত্যন্ত দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ দুই দেশের অগ্রযাত্রার তুলনামূলক বিচারে চীন যে ভারতের চেয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে এটি তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি। তবে ভারতের একটি প্রশংসনীয় দিক হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা চীনে নেই। ড. সেন গণতন্ত্রের পূজারি। তিনি বেশ জোরের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন লেখায় বলেছেন, গণতন্ত্র থাকলে দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। তিনি বলেছেন, ১৯৫৯-৬২ সালে চীনে দুর্ভিক্ষে তিন কোটি লোক মারা গেছে। অমর্ত্য সেনের লেখা এবং দর্শন নিয়ে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির আলোচনা করা শোভা পাবে না। তিনি চীন-ভারত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ দশমিক ১ বছর, আর ভারতে ৬৪ দশমিক ৪ বছর, বাংলাদেশে কম ওজনের শিশুর হার ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ভারতের চেয়ে কম (৪৩ দশমিক ৬)। বাংলাদেশে স্কুল অধ্যয়নের গড় সময় ৪ দশমিক ৮ বছর, ভারতের ৪ দশমিক ৪ বছর। ১৫-২৫ বছরের সময়সীমার পুরুষের সাক্ষরতার হারের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের এই বয়সের মহিলাদের সাক্ষরতার হার ভারতের চেয়ে বেশি। তরুণ বাংলাদেশিদের মধ্যে নারী সাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় বেশি। স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার যেখানে প্রতিবছর ৫২, সেখানে ভারতে তা ৬৬। শিশুমৃত্যুর হারের দিক দিয়েও বাংলাদেশ একই রকম সুবিধাজনক অবস্থানে। ভারতে এই হার প্রতি হাজারে ৫০ আর বাংলাদেশে ৪১। বাংলাদেশে যেখানে ৯৪ শতাংশ শিশুকে ডিপিটি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, সেখানে ভারতের মাত্র ৬৬ শতাংশ শিশুকে এই টিকা দেওয়া হয়। ড. সেন আরো বলেছেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো। জিডিপি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। জীবনের সামগ্রিক মানোন্নয়ন শুধু জিডিপি বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে না। জিডিপি বৃদ্ধি মানে সম্পদ বৃদ্ধি। সেটি ভালো কথা। কিন্তু এর যদি সুষম বণ্টন না হয়, কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা মানকে শক্তিশালী করা না হয়, তাহলে এই বৃদ্ধি সমাজে কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। ভারতে এত সম্পদ বৃদ্ধির পরও বিশ্বের বৃহত্তম বস্তি মুম্বাইয়ে অবস্থিত। একটি জাতির মানবসম্পদের উন্নয়ন মানে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি। সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। অতএব জিডিপির প্রবৃদ্ধি কম হলে সামাজিক অবকাঠামোর বিভিন্ন দিক যদি ঠিকমতো উন্নত হয়, তাহলে ক্ষতির কিছু নেই। যেসব কথা বলা হতো যে ধনীর সম্পদ চুইয়ে চুইয়ে গরিবের ঘরে ঢোকে, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অবাধ মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থকরা এসব কথা বলতেন। কথাটি এ জন্য বলছি, বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেমন বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা এবং বিকলাঙ্গতার জন্য সাহায্য_এসব বেশ কিছুটা সুফল বয়ে এনেছে। যে কারণে বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা তুলনামূলক বা আনুপাতিক হারে ভারতের চেয়ে কম।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ইংরেজরা এই উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র_একটি ভারত এবং অপরটি পাকিস্তান। আমরা পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হলাম। স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, তা আমরা পাইনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাব সিভিল মিলিটারি আমলাদের হাতে পড়লাম। এরপর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা শোষণহীন একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলব, কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র কিছুদিন পরই অগণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হলো। এই শাসনের অবসান হতে দেড় যুগ সময় লাগল। ভারতে হাজার সমস্যার ভেতর নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। ভারত বড় দেশ, সেখানে বহু ভাষাভাষীর মানুষ বাস করে। জাতপাতের ব্যাপারটিও রয়েছে। এককথায় বলতে গেলে তারা শতধায় বিভক্ত; কিন্তু তাদের এক রেখেছে গণতন্ত্র, অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্র। আমাদের এখানেও ১৯৯১ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে। ভাষা, জাতি_এসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিছু কিছু অঞ্চলে আদিবাসী বা উপজাতিরা বাস করেন। তবে সে সমস্যা তেমন প্রকট নয়। বরঞ্চ সমস্যা জটিল আমাদের নিজেদের ভেতর। দেশের দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাফল্য আনতে হলে পূর্বশর্ত হলো ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল উভয়েই উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। কেন না উভয়ের তো জনসমর্থন রয়েছে, উভয়েই তো ক্ষমতায় আসছে। তাহলে কেন এত হানাহানি আর বিভাজন। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয়ই নির্বাচিত মেয়াদকাল কাটিয়েছে। কেউ কাউকে হটাতে পারেনি। কিন্তু কেউ কাউকে তার নির্বাচিত সময়টিতে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। বারবার হরতাল ডাকা হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশেও এই অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আমরা হলফ করে বলতে পারি, আমাদের রাজনীতিকরা যদি ঐকমত্যের রাজনীতি করতেন, তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি আরো বাড়ত।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের উন্নতির জন্য কতটা আগ্রহী, তার দু-একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। কৃষিতে যখনই সরকার ফসল ফলানোর জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, কৃষকরা তার সুষ্ঠু ব্যবহার করে বাম্পার ফসল উৎপাদন করে দিয়েছেন। তাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে শিশুদের ডিপিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ৯৪ শতাংশ, এর বিপরীতে ভারতের সাফল্য ৬৬ শতাংশ। এটা ঠিক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো প্রচার করেছে। তবে জনগণের সাড়া পেতে হবে। এই সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে পুরুষদের চেয়ে নারীদের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। এককথায় বলা যায়, আমাদের জনগণ অত্যন্ত সচেতন, তারা দেশের তথা সমাজের গঠনমূলক এবং উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে চায়, যথাযথ ভূমিকা রাখতে চায়। সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে, ২০২১ সালের ভেতরে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। কাজটা কঠিন ছিল না যদি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠত। আমরা এটা বুঝতে পারি না, রাজনীতিবিদদের জীবনের ব্রত যদি হয় মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করা, তাহলে নিজেদের মধ্যে এত কলহ, এত হানাহানি কেন? ব্যক্তিগত জেদ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ_এসবের ঊধর্ে্ব উঠে রাজনীতি করতে হয়। রাষ্ট্রের মর্যাদা, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অনুধাবন করতে হবে। আমাদের জনগণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে কতটা আগ্রহী, তা মোবাইল ফোন ব্যবহারের সংখ্যা দেখে আঁচ করা হয়। প্রথম যখন বিশুদ্ধ পানি বোতলজাত করে বিক্রি শুরু হয়, তখন এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন, এটি নগরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এখন নিভৃতপল্লীতেও এই পানি ব্যবহার হচ্ছে। আমরা অপার সম্ভাবনাময় একটি জাতি, মুক্তচিন্তার জাতি। অতীতে অনেক চেষ্টা, অপচেষ্টা করেও আমাদের সাম্প্রদায়িক এবং গোঁড়া বানানো যায়নি। আশা-ভরসা সেখানেই।
লেখক : সাবেক ইপিএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.