স্মরণ-আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় : জীবন ও কর্ম by গৌরাঙ্গ নন্দী

নির্লোভ, পরোপকারী, শিক্ষাবিস্তারে নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষ। যেখানেই মানুষের দুর্ভোগ, সেখানেই তিনি। তাই স্বাধীনতাসংগ্রামী হোক আর ঝড়-বন্যায় দুর্যোগগ্রস্ত মানুষ হোক, সবারই সহায় হয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। এই মহান কর্মযোগী মানুষটি আর কেউ নন_আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যাঁকে এ পি সি রায় নামে আমরা চিনি।


১৮৬১ সালের ২ আগস্ট তিনি সাবেক যশোর, বর্তমানে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলাধীন রাঢ়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পড়াশোনা শুরু কলকাতার হেয়ার স্কুলে। সেখানকার অ্যালবার্ট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে পড়েন। বিএ ক্লাসের জন্য ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বিএ পাস করার আগেই গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৮২ সালে বিলেতে যান। সেখানে বিএসসি পাস করেন এবং ১৮৮৭ সালে রসায়নশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোপ পুরস্কার পান। ১৮৮৮ সালে দেশে ফেরেন। পরের বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর শিক্ষক ও গবেষকজীবন। এরপর ১৯৩৭ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি যখন পরিপূর্ণ অবসর নিতে চাইলেন, তখন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে রসায়নের গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখেন। বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়ে তিনি কলেজেরই দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি ঘরে থাকতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই ঘরে কাটিয়েছেন। কলেজে সব সময় ৮-১০ জন ছাত্র গবেষণাকাজের জন্য তাঁর কাছে থাকতেন। তাঁর প্রথম মৌলিক গবেষণা খাবারে ভেজাল নির্ণয়ের রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন-সংক্রান্ত। তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার মারকিউরাস নাইট্রাইট। এ ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতু আবিষ্কার করে তিনি রসায়নজগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। গবাদি পশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক এসিড যোগ করে তিনি সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন।
শুধু গবেষণা নয়, গবেষণার ফল কাজে লাগানোর জন্য তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস।
১৯১৯ ও ১৯২০ সালে পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টির কারণে সমগ্র খুলনা (বর্তমান খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা) জেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অজন্মার কারণে তখনকার সাতক্ষীরা মহকুমাজুড়ে এবং পাইকগাছা (বর্তমান পাইকগাছা ও কয়রা) ও দাকোপ থানা এলাকায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯২১ সালে চতুর্থবার বিলাত থেকে আসার পর গরমের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে এসে তিনি দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন। বহু মানুষ তত দিনে মারা গেছে। অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে, পচা-দূষিত পানি পান করে রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ে। ছড়িয়ে পড়ে ম্যালেরিয়া। জেলা কালেক্টরেট (বর্তমানে জেলা প্রশাসক) এই দুর্ভিক্ষের কথা স্বীকার করেননি। মানুষকে বাঁচাতে এই মহান ব্যক্তির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে রিলিফ কমিটি। ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হলে সেখানেও ছুটে যান তিনি। সেখানকার মানুষকে রক্ষায় গঠিত ত্রাণ কমিটিরও সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
ভারতে বিধিবদ্ধ সমবায় আইন চালু হয় ১৯০৪ সালে। ১৯০৬ সালে তিনি রাঢ়ুলি এবং এর আশপাশের গ্রামের মানুষকে জড়ো করে ৪১টি কৃষি ঋণদান সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। ১৯০৮ সালে আচার্য দেব এবং তাঁর ভাই রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরীর চেষ্টায় সমবায় সমিতিগুলো নিয়ে রাঢ়ুলি সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল অবিভক্ত বাংলায় তৃতীয় ব্যাংক।
চিরকুমার প্রফুল্ল চন্দ্রের জীবন ছিল অনাড়ম্বর। ছাত্রদের সঙ্গে ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জাতীয় শিক্ষা ও শিল্পোদ্যোগের প্রতি ছিল অকৃপণ সহায়তা। মানবকল্যাণে নিজের অর্জিত সব অর্থ অকাতরে দান করেছেন। ৭৫ বছর বয়সে তিনি পালিত অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পরও আট বছর বেঁচে ছিলেন। সেই সময়ও কেটেছে বিজ্ঞান কলেজের ওই ছোট কক্ষে, যেখানে ছিল একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, খাবার ছোট একটি টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও একটি আলনা। যেসব ছেলে তাঁর কাছে থাকত, তাদেরই একজনের হাতে মাথা রেখে তিনি ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গৌরাঙ্গ নন্দী

No comments

Powered by Blogger.