দুই শ কিংবা দুই সতিন by রাজীব হাসান

আপনারা নিশ্চয়ই সেই কৌশলটার কথা জানেন। পড়ে গেছেন গরুর রচনা। পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখলেন, রচনা এসেছে নদীর। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। নদীর কাছে গরুটাকে নিয়ে যান: ‘আমাদের গ্রামে একটা নদী ছিল। কী সুন্দর আঁকাবাঁকা নদী! রোজ বিকেলে নদীর ধারে আমরা আমাদের গরুটাকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেতাম। গরু একটি গৃহপালিত পশু।


গরুর চারটি পা, দুটো কান, দুটো শিং আর একটি লেজ আছে। গরু আমাদের দুধ দেয়, হাল চাষে সাহায্য করে...।’
একই কৌশল যে আরও বৃহৎ পরিসরে খাটানো যায়। সেটাই শিখেছিলাম লেখালেখির এক কর্মশালায়। ধরুন, আপনাকে নিবন্ধ লিখতে দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে। কিন্তু ওই গরুই সম্বল। একদম ঘাবড়াবেন না। লিখতে শুরু করে দিন: ‘বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশে কৃষিই মূলত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আর কৃষি যেখানে আছে, সেখানে গরুর উপস্থিতি অনিবার্য। কারণ, গরু একটি গৃহপালিত পশু। গরুর চারটি পা, দুটো কান, দুটো শিং আর একটি লেজ আছে। গরু আমাদের দুধ দেয়, হাল চাষে সাহায্য করে...।’
কিংবা ধরুন আরও সিরিয়াস কোনো বিষয়: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এবারও গরুই আপনার সম্বল। ‘বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক উত্তপ্ত কড়াই। এই দেশে সরকারি দল আর বিরোধী দলের সম্পর্ক এখন আর সাপে-নেউলেও নেই, দা-কুমড়াও নেই। সেটা আরও বিষাক্ত হয়ে গেছে—বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক! বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবশ্য বিরোধী দলের চেয়ে সরকারের দায়ই বেশি। সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গরুর মতো একটা অবলা, নিরীহ প্রাণীকে যদি ক্রমাগত খোঁচানো হয়, সে-ও একসময় শিং দিয়ে গুঁতোবেই। কারণ, গৃহপালিত প্রাণী হলেও গরুর দুটো শিং আছে। আছে চারটি পা, দুটো কান আর একটি লেজ। গরু আমাদের দুধ দেয়, হাল চাষে সাহায্য করে...।’
এই কৌশল খাটিয়েই আসলে করে খাচ্ছি। আমাকে যা-ই লিখতে দেওয়া হোক না কেন, ঘুরে-ফিরে আমি গরুর রচনাই চালিয়ে দিই। কিন্তু গৃহস্থেরও একদিন আসে যেদিন চোরকে ধরা পড়তেই হয়। বলতে পারেন আজই সেই দিন। কারণ রস+আলো সম্পাদক আমাকে বলেছেন, ‘এবারেরটা ২০০তম সংখ্যা। আপনার লেখার বিষয় হবে ২০০।’ ২০০! স্রেফ ‘২০০’ নিয়ে কিছু লেখা যায় বলুন? ২০৩ কিংবা দুই সতীন হলেও একটা কথা ছিল, রগরগে একটা গল্প ফেঁদে দিতাম।
আমার জানামতে, বিশ্বের সবচেয়ে বহুপ্রজ লেখকদের একজন রবীন্দ্রনাথ। নাটক-গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-ছড়া-চিঠি মিলে সাত কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৩৭ শব্দ লিখে গেছেন রবিঠাকুর। সেই তাঁকেও যদি বলা হতো, গুরুদেব, একটা লেখা দেন, লেখার বিষয় হলো ২০০; রবীন্দ্রনাথ ভিরমি খেয়ে যেতেন। কিংবা ওই গরু-পদ্ধতি খাটিয়ে লিখে ফেলতেন: ‘আজি হতে দুই শত বর্ষ পরে/ কে তুমি টিপিছো বসি/ হলোগ্রাফিক কম্পিউটারখানি/ কৌতূহলভরে...।’
দেখেছেন, গরু-পদ্ধতির কার্যকারিতা। আমি এরই মধ্যে বরাদ্দ ৭০০ শব্দের অর্ধেক ব্যয় করে ফেলেছি। কিন্তু ‘২০০’ নিয়ে একটা শব্দও লিখিনি। হিহিহি। তবে এভাবে তো আর ফাঁকি দেওয়া যাবে না। ফলে গরিবের শেষ ভরসা হিসেবে ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম ‘২০০’ নিয়ে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পেলাম।
প্রথম তথ্য: বিশ্বের মোট সম্পদের ৪ ভাগের ১ ভাগই ২০০টি কোম্পানির দখলে। একটুও চমকাইনি। বাংলাদেশের মোট সম্পদের ৮০ ভাগই নাকি ২০টি পরিবারের দখলে; সে হিসাবে এ তো নস্যি! দ্বিতীয় তথ্য: অঙ্কে সবচেয়ে প্রতিভাধর ফুলের নাম ড্যান্ডিলায়ন। এই বুনো ওষধিটি গুনে গুনে ঠিক ২০০টি বীজ দেয়। একদমই হেরফের হয় না। ‘ফুল’ মানে আমি জানতাম বোকা কিছিমের কিছু একটা। এখন দেখছি, ফুলের মধ্যেও অঙ্কে যাদব পণ্ডিত টাইপও আছে! তৃতীয় তথ্যটি হূদয়বিদারক: প্রতিবছর গড়ে ২০০ জন জাপানি কর্মকর্তা গলফ খেলতে গিয়ে গলফ কোর্সেই মারা যান। এটি নিতান্তই স্পর্শকাতর বিষয়, তাই কোনো মন্তব্য নেই। তবে ৪ নম্বর তথ্যটি বেশ ইন্টারেস্টিং: গ্রিক পুরাণের ‘টাইফুন দ্য টাইটান’ নামের দৈত্যটির চোখের সংখ্যা ২০০। প্রতিটি চোখ দিয়েই ঝরে আগুন। আহা, এমন কিছু দৈত্য ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় থাকলে ভালো হতো। গ্যাসসংকটের কারণে কত দিন যে মানুষের ঘরে রান্না হয় না!
২০০ নিয়ে আরও অনেক তথ্যই পেলাম। ক্রিকেটে ২০০ নিয়ে, না, ঠিক ২০০ নিয়ে নয়; ২০০ না-হওয়া নিয়ে কিছু মজার ঘটনা আছে। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন আর ম্যাথু এলিয়ট এই দুজন টেস্টে ১৯৯ রান করে আউট হয়েছেন। মাত্র এক রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি না-পাওয়ার দুঃখ চিরসঙ্গী হয়েছে তাঁদের। কখনোই যে ডাবল সেঞ্চুরি করা হয়নি। ‘একটুর জন্য’ না-পাওয়ার বেদনা আজহারের চেয়ে আর কেউ বোধ হয় জানে না। বেচারা খেলেছেনও ৯৯ টেস্ট! শততম টেস্ট খেলুড়েদের অভিজাত তালিকায় ঢোকাই হলো না!
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ক্যারিয়ারে ডাবল সেঞ্চুরি আছে। কিন্তু তার পরও ২০০ নিয়ে একটা দুঃখ তাঁর ঘোচেনি। টেস্ট ইতিহাসে ১৯৯ রানে অপরাজিত থাকার একমাত্র হতভাগা যে তিনিই। ও-প্রান্তের বাকি ব্যাটসম্যানের সবাই পটাপট আউট হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ২০০ করা হয়নি তাঁর!
তবে এসবের কিছুই নয়, আমার কাছে ‘২০০’ নিয়ে সবচেয়ে মজার তথ্য মনে হয়েছে এটি: ১৯৯১ সালে মোৎসার্টের ২০০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাপানের সুবিখ্যাত অন্তর্বাস-নির্মাতা ট্রাইআম্প ইন্টারন্যাশনাল বানিয়েছিল বিশেষ এক বক্ষবন্ধনী। পৃথিবীর প্রথম ‘মিউজিক্যাল ব্রা’। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কিছু লাইট লাগানো ছিল যেগুলো তারার মতো জ্বলত। আর ২০ সেকেন্ডের জন্য বেজে উঠত সুর: ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার’। মোৎসার্টকে সম্মান জানানোর অভিনব উপায় সন্দেহ নেই। সমস্যা হলো, টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার ছড়াটি লিখেছিলেন লন্ডনের দুই বোন জেন আর অ্যান টেলর। আর সুরটা আসলে ফরাসি লোকগীতি। ট্রাইআম্প জানতই না, এর সঙ্গে মোৎসার্টের কোনো সম্পর্কই আসলে নেই!
সম্পর্ক থাকতেই হবে? রস+আলোর ২০০তম বিশেষ সংখ্যার সঙ্গে এই লেখাটির সম্পর্কই বা কী, আমাকে বলুন তো!

No comments

Powered by Blogger.