বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শামসুল হক, বীর বিক্রম
অনন্য সাহসী যোদ্ধা ছিলেন তিনি শামসুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে অবস্থান নিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলের নেতৃত্বে শামসুল হক।


সব দল যার যার অবস্থান নিয়েছে। এখন অধিনায়ক সংকেত দিলেই আক্রমণের পালা। মুক্তিযোদ্ধারা সেই সংকেতের জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন সময় পাকিস্তানিরাই তাঁদের আক্রমণ করল। ব্যাপক হারে গোলা এসে পড়তে থাকল শামসুল হকদের অবস্থানে। বিরামহীন ও ভয়াবহ গোলাবর্ষণ। শামসুল হক মনোবল হারালেন না। চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সহযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে এগিয়ে যেতে থাকলেন সামনে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা হতবাক হয়ে পড়ল। এ ঘটনা কানাইঘাটে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করে। তখন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দলের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুল হক।
কানাইঘাট ছিল মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন মেজর সি আর দত্ত (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল)। তাঁর এক সাক্ষাৎকারে এ যুদ্ধের বিবরণ আছে। তিনি বলেন, ‘...কানাইঘাটে শত্রুদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকাল প্রায় সাড়ে ১০টায় মেজর রব, লেফটেন্যান্ট গিয়াস ও লেফটেন্যান্ট জহিরের অধীন মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে শত্রুসৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তানিরা রাস্তা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে শুরু করল। যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। নদীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিল। অনেকে পানিতে ডুবে মারা যায়। ভীষণ শব্দে মাইনগুলো ফাটছিল। যারা চরখাই দিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। বেলা ১১টায় কানাইঘাট আমাদের দখলে এল।’
‘কানাইঘাট যুদ্ধে পাকিস্তানিদের মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০ জন। আহত ২০ জন। আমাদের পক্ষে শহীদ হয়েছে ১১ জন। আহত হয়েছিল ১৫ জন।’
‘এত বড় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি বলে যারা ভালো কাজ করেছে তাদেরকে উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সর্বাধিনায়কের কাছে নাম পাঠিয়েছিলাম। তারা হলো মেজর রব, লেফটেন্যান্ট জহিরুল হক, সুবেদার মতিন, সুবেদার বাছর আলী, নায়েব সুবেদার শামসুল হক প্রমুখ।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
শামসুল হক চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যাওয়ার পর প্রথম যুদ্ধ করেন ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে। পরে ৪ নম্বর সেক্টরে। ধামাই চা-বাগানের যুদ্ধে শামসুল হক অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এ যুদ্ধে তাঁর দলনেতা (কোম্পানি কমান্ডার) লেফটেন্যান্ট এস এম ইমদাদুল হক (বীর উত্তম) শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শামসুল হককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৩।
শামসুল হকের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার জিনোদপুর ইউনিয়নের বলিবাড়ি গ্রামে। বর্তমানে এ বাড়িতেই তিনি সপরিবারে বাস করেন। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ আলী মুন্সি। মা নূরেন্নেছা বেগম। স্ত্রী আফিয়া বেগম। তাঁর চার ছেলে দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দেবনাথ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.